অভিনেতা নয়, বডিবিল্ডারই হতে চেয়েছিলেন রবি ঘোষ

বিশ্বখ্যাত পরিচালক-অভিনেতা চার্লি চ্যাপলিন বলেছিলেন, “To truly laugh, you must be able to take your pain, and play with it.” তারপর আরও বলেছিলেন, “Life is a tragedy when seen in close-up, but a comedy in long-shot.” এই অমোঘ সমস্ত কথাগুলির সঙ্গে দৃশ্যত মানিয়ে যায় আমাদের প্রত্যেকের পছন্দের এক অভিনেতার নাম। ‘গল্প হলেও সত্যি’, ‘গুপী গাইন বাঘা বাইন’, ‘অভিযান’, ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’, ‘হীরক রাজার দেশে’, ‘পদ্মানদীর মাঝি’, ‘বসন্ত বিলাপ’, ‘কাপুরুষ ও মহাপুরুষ’ ছবিগুলিতে একের পর চুটিয়ে অভিনয় করে নিজের জাত চিনিয়েছিলেন ভারতবর্ষের অন্যতম শ্রেষ্ঠ অভিনেতা রবি ঘোষ। নায়কোচিত চেহারা না হলেও সে যুগের বাংলা ছবির সমস্ত পরিচালকের প্রিয় পাত্র ছিলেন রবি। তাঁর হাত ধরেই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে এসেছিলেন কত কত সফল অভিনেতা-অভিনেত্রী। বাংলা চলচ্চিত্রের ‘বা-বা’ তো তিনিই।
১৯৩১ সালে জন্মগ্রহণ করেন রবীন্দ্রনাথ ঘোষ দস্তিদার। যিনি পরবর্তীকালে রবি ঘোষ হিসাবে সমাদৃত। আজীবন বাংলা ছবির ‘কমেডিয়ান’ তকমা পাওয়া এই মানুষটি কিন্তু একেবারেই অভিনেতা হতে চাননি। রবি ঘোষের ছাত্র জীবন কাটে কলকাতার আশুতোষ কলেজে। ছাত্রাবস্থাতেই পড়াশোনার পাশাপাশি চলত নিয়মিত শরীরচর্চা। সেই সময় মাস্ল ফুলিয়ে, ছাতি চওড়া করে সিনেমায় ‘হিরো’ হওয়ার চল ছিল না। সুন্দর মুখ আর শক্তিশালী অভিনয়েই প্রত্যেকে স্ব-স্ব ক্ষেত্রে নিজের জাত চেনাতেন।
কিন্তু রবি ঘোষের বডি থাকলেও না ছিল সুন্দর চাঁদপানা মুখ, না ছিল উচ্চতা। তপন সিংহ-এর ‘গল্প হলেও সত্যি’ ছবিতে রবি ঘোষের অভিনয় দেখলে বোঝা যাবে আসল হিরো তো তিনিই। ওরকম দাপুটে অভিনয় আর মানানসই চেহারায় গোটা ছবি জুড়ে একাই দাপিয়ে বেড়িয়েছেন। উত্তমকুমার-সৌমিত্রদের যুগেও ভেঙে ফেলেছিলেন স্টিরিওটাইপ তকমা। সিনেমার ভাষ্যে নিয়ে এসেছিলেন একটা অন্য হাওয়া। যে হাওয়ায় সহজেই গা ভাসানো যায়, যে হাওয়ার রেশ থাকে বহু বহু বছর, কিন্তু তাকে ধরা বড্ড শক্ত। কালো, বেঁটে ওই লোকটাই সেই যুগে মিনার্ভা থিয়েটার হাউসফুল করতেন একাই। লোকে বলাবলি করত, রবি ঘোষ মানেই একাই একশো।
রবি ঘোষের অভিনয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্যই ছিল হাস্যরসের মাধ্যমে সামাজিক রূঢ় বাস্তবিক ঘটনাগুলিকে দর্শকের সামনে উপস্থাপন করা। অভিনয়ের আন্তরিকতা ও সংবেদনশীলতা তাঁর প্রতিটি চরিত্রকে নতুন আঙ্গিকে হাজির করেছিল। কে বলবে, ইনি অভিনেতা নয়, বডিবিল্ডারই হতে চেয়েছিলেন!
এই রবি ঘোষ তাঁর অভিনয়ের গুরু বলে মানতেন চার্লি চ্যাপলিনকে। যে চ্যাপলিন বলেছিলেন, “Actors search for rejection. If they don’t get it they reject themselves.” এখন আর কমেডিয়ানদের যুগ নেই। সারা বছরে হয়তো গুটিকয়েক কমেডি ছবি মুক্তি পায়। একটিও বক্স-অফিস সাফল্য নয়। অনেকবছর আগে অনীক দত্তের ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ রমরমিয়ে চলেছিল বটে। তাও হাতেগুনে ওই একটিই। এখনকার কমেডি বাংলা ছবি জোর করে কাতুকুতু দিয়ে লোক হাসায়। কিন্তু রবি ঘোষকে কেউ ভোলেনি। ‘দ্য রিয়্যাল হিরো’কে ভুলে যাওয়া সহজ নয়। শুধু বডি বডি করে না কাটিয়ে পড়াশোনাও করেছেন নিজের মতো। তাঁর পড়াশোনা, বিশ্বের বিভিন্ন ছবি দেখা কত সমৃদ্ধ, সবকিছুই বোঝা যাবে রবি ঘোষের বিভিন্ন সাক্ষাৎকার শুনলে। ভাগ্যিস তিনি অভিনয়ে এলেন! নাহলে এই ক্ষুদ্র জীবন নতুন দর্শনের ভ্রমণে ঘুরতে পারত না।