জোড়াসাঁকোর নাট্যশালাটি এবং 'অলীকবাবু' রবীন্দ্রনাথ

“এ বাড়ির বারান্দায় ঝুঁকে পড়ে তাকিয়ে থাকতুম; দেখতুম ও-বাড়ির নাচঘর আলোয় আলোময়। দেউড়ির সামনে বড়ো বড়ো জুড়িগাড়ি এসে উঠেছে। সদর দরজার কাছ থেকে দাদাদের কেউ কেউ অতিথিদের উপরে আগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন।”
বয়স হলে স্মৃতিতে পাক ধরে। ‘জীবনস্মৃতি’-তে রবীন্দ্রনাথ তো নিজের ছোটোবেলার স্কুলের নামটিও গুলিয়ে ফেলে লিখেছিলেন ওরিয়েন্টাল সেমিনারির কথা। কিন্তু নিজেদের ঠাকুরদালানে তৈরি হওয়া আটপৌরে সেই নাট্যশালার স্মৃতি কিন্তু জীবনের শেষপ্রান্তে এসেও আবছা হয়নি। ‘ছেলেবেলা’ বইতে ওপরের বর্ণনাটি যখন দিচ্ছেন রবীন্দ্রনাথ, তখন তাঁর আশি বছর বয়স। সেই কবেকার কথা। কিন্তু, আলোয় আলোময় জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ির নাচঘরে অভিনয়ের গল্পগুলো যেন তখনো টাটকা।
এমনিতে গোটা উনিশ শতক জুড়েই হাজার একটা উদ্যোগ। প্রতিদিনই কিছু-না-কিছু ঘটে চলেছে। স্কুল-কলেজ প্রতিষ্ঠা, প্রাচীন-বনাম-নবীন দক্ষযজ্ঞ, ধর্মান্তর-- আর এসবের পাশাপাশি সাহিত্যের, শিল্পের এক উচ্চকিত স্রোতধারা। হাজার একটা ধারায় তা কেবলি বিকশিত হয়েছে সে যুগে। তাতে যে পরিবারটি আদ্যন্ত ইতিবাচক ভূমিকা রেখে গেছে, সে হল জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি। বাংলা থিয়েটারের তখন সদ্য পা-মেলে হাঁটতে শেখা। অনেকগুলি বাম্পার পেরিয়ে সে এগোচ্ছে। একদিকে সংস্কৃত নাটক, অন্যদিকে বিলিতি থিয়েটার। সে কোন আদর্শ মানবে, তা নিয়ে দ্বন্দ্ব। সেই টলোমলো পায়ে এগিয়ে যাওয়ায় ঠাকুরবাড়িই বা বাদ যায় কেন! তাই তার ঠাকুরদালানেও তৈরি হয়ে গেল একদিন জোড়াসাঁকো নাট্যশালা।
ঠাকুরবাড়িতে নাটকের পরিবেশ অবশ্য আগে থেকেই ছিল। প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর স্বয়ং জড়িয়ে ছিলেন ইংরেজদের চৌরঙ্গী এবং সাঁ সুসি থিয়েটারের সঙ্গে। খোদ ঠাকুরবাড়িতে অভিনীত হয়েছিল গিরীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাবুবিলাস’ নামে একটি নাটক। তারপর, জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুর, সারদাপ্রসাদ গঙ্গোপাধ্যায় আর গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্যোগে ১৮৬৫ সালের মাঝামাঝি তৈরি হল জোড়াসাঁকো নাট্যশালা। দ্বারকানাথ ঠাকুরের মধ্যম পুত্র গিরীন্দ্রনাথের অংশে (৫ নম্বর বাড়ি) নাট্যশালাটি গড়ে উঠল। এই গিরীন্দ্রনাথেরই ছোটোছেলে গুণেন্দ্রনাথ। ধর্মমতে দেবেন্দ্রনাথের পরিবার ব্রাহ্ম হলেও গিরীন্দ্রনাথরা ছিলেন হিন্দু। তাতে অবশ্য একত্রিত হতে কোনো অসুবিধে হয়নি।
এমনিতে সেই যুগটা সখের নাট্যশালার। কলকাতায় তখন একের পর এক ধনী বাড়িতে নাটকের অভিনয় চলছে। সেসবের চাইতে ঠাকুরবাড়ির নাট্যশালাটি শুরু থেকেই আলাদা। এখানে ইংরেজি থিয়েটারের আদলের সঙ্গে দেশীয় রীতির মিশ্রণের চেষ্টা হল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘জীবনস্মৃতি’ থেকে জানা যায়, টানা তিনদিন ধরে যাত্রাপালা চলেছিল ঠাকুরবাড়িতে। সেকালে বিখ্যাত ছিল গোপাল উড়ের যাত্রাগান। তিনিও এসেছিলেন ঠাকুরবাড়িতে। সেই যাত্রাগান জ্যোতিরিন্দ্রনাথকে হয় উদ্বুদ্ধ করেছিল, নয়তো অসন্তুষ্ট করেছিল। লোকে দু-রকমই বলে থাকে। মোদ্দা কথা, তার পরপরই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ তৈরি করলেন এই নাট্যালয়। পাঁচজনের একটি কমিটিও তৈরি হয়ে গেল নিমেষে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ, গুণেন্দ্রনাথ বাদে তাতে রইলেন কৃষ্ণবিহারী সেন, অক্ষয় মজুমদার এবং যদিনাথ মুখোপাধ্যায়।
পাঁচ নম্বর ঠাকুরবাড়ির দোতলার হলঘরে মঞ্চ বাঁধা হল। প্রথম যাত্রায় তাঁরা বেছে নিলেন মধুসূদনকে। ‘কৃষ্ণকুমারী’ নাটক মঞ্চস্থ হল। তখনো তো ঠাকুরবাড়ির মেয়েরা অভিনয় শুরু করেননি। তাই পুরুষরাই অভিনয় করলেন নারীর ভূমিকায়। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ নিজে সেই নাটকে সেজেছিলেন অহল্যাদেবী। এর পর-পরই ‘একেই কি বলে সভ্যতা’-র অভিনয়।
নাট্যালয় টিকিয়ে রাখতে গেলে নতুন নতুন নাটক দরকার। আর সেই নাটকের বিষয় হতে হবে সমসাময়িক। কী করণীয়? ঠাকুরবাড়িতে তখন ডাক পড়েছিল ওরিয়েন্টাল সেমিনারির শিক্ষক ঈশ্বর নন্দীর। তাঁর পরিকল্পনায় জোড়াসাঁকো নাট্যালয়ের তরফে প্রকাশিত হয়েছিল একটি বিজ্ঞাপন। সমকালীন সামাজিক-সমস্যা বিষয়ক নাটক লেখার প্রতিযোগিতা। যার নাটক মনোনীত হবে, সে পাবে ২০০টাকা। সেকালে ২০০ টাকা স্বাভাবিকভাবেই মহামূল্যবান। সেই প্রতিযোগিতা জিতে গেলেন ‘কুলীনকুলসর্বস্ব’-খ্যাত রামনারায়ণ তর্করত্ন। তাঁর ‘নবনাটক’ (আক্ষরিক অর্থেও নব) নির্বাচিত হল। পুরস্কার তো তিনি পেলেনই। পাশাপাশি তার অভিনয় দর্শককে মুগ্ধ করে দিল।
১৮৬৭ সালের ৫ই জানুয়ারি প্রবল শীতের সন্ধ্যায় প্রথম অভিনীত হল সেই নাটক। তাঁর জাঁকজমকময় আয়োজনের কথাই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ।
নাটকটিতে নট সেজেছিলেন নীলকমল মুখোপাধ্যায়, নটি জ্যোতিরিন্দ্রনাথ স্বয়ং। অক্ষয় মজুমদার সেজেছিলেন নাটকটির কৌতুকচরিত্র ‘গবেশবাবু’। আর তার তিন স্ত্রী- মণিলাল মুখোপাধ্যায়, বিনোদ গাঙ্গুলি ও সারদাপ্রসাদ গাঙ্গুলি, যিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথের বড়োদিদি সৌদামিনীর স্বামী। তাঁর অভিনয়ের দক্ষতার কথা উল্লেখ করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ নিজেই—“...নাটকের থেকে কুলীন মেয়ের ফুঁপিয়ে কান্না কখনো কখনো কানে আসে, তার মর্ম বুঝতে পারিনে। বোঝবার ইচ্ছেটা হয় প্রবল। খবর পেতুম, যিনি কাঁদতেন তিনি কুলীন বটে, কিন্তু তিনি আমার ভগ্নীপতি।”
এরপর মোট ন-বার অভিনীত হয়েছিল সেই নাটক। নাটকের সিনে অন্ধকার বনপথ তৈরি হত আসল গাছপালায়। সেখানে আলো দিত আসল জোনাকিপোকা। আগে থেকে তাদের ধরে রাখার ব্যবস্থা থাকত। ১৮৬৭ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি শেষ অভিনয় হয় সেই নাটকের। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বোম্বে চলে গেলে এই জমজমাট থিয়েটারেও যবনিকা নামে।
অবশ্য, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ‘এমন কর্ম আর করব না’ প্রহসন অভিনয়ের মাধ্যমে ফের পুনর্জীবিত হয় জোড়াসাঁকো নাট্যশালা। রবীন্দ্রনাথ তখন কিশোর। এই নাটক্যের প্রধান উদ্যোগী ও প্রধান চরিত্রাভিনেতাও তিনি। রবীন্দ্রনাথের এটাই প্রথম অভিনয়। এরপরে, একে একে আসবে মানময়ী গিটিনাট্য, পুনর্বসন্ত, বিবাহ উৎসব। তারপর, ১৮৮১ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘বাল্মীকি প্রতিভা’। জোড়াসাঁকোর তেতলার ছাদে পাল খাটিয়ে অভিনয় হল রবীন্দ্রনাথ রচিত, সুরারোপিত, নির্দেশিত ও অভিনীত এই গীতিনাট্যের। বাল্মীকির ভূমিকায় স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ সরস্বতী তাঁর ভাইঝি প্রতিভাদেবী। এই নাটকের অভিনয় তো বাংলা নাটকের পৃথিবীতে ঐতিহাসিক ঘটনা নিঃসন্দেহে। নাট্যকার রবীন্দ্রনাথের সার্থক জন্ম এখানেই। আর, এই ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইল তাঁরই বাড়িতে গড়ে ওঠা একটি নাট্যশালা।
ঠাকুরবাড়ির নাটমঞ্চের আলো জ্বলেছিল বহুকাল পর্যন্ত। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের পর উত্তরাধিকার বাহিত হল রবীন্দ্রনাথে। রবীন্দ্রনাথের হাতে বাংলা নাটকের ভিন্ন এক ভাষাশরীর প্রাপ্তিকে নিজের চোখে দেখল এই নাট্যশালা। বড়ো অভিনয় থাকলে ঠাকুরবাড়িতে মানুষ উপচে পড়ত। কত বিখ্যাত মানুষ অতিথি হয়ে আসতেন অভিনয়ের দর্শক হিসেবে। পুরোনো কালের সেই চিৎপুরের রাস্তায় জুড়িগাড়ির জ্যামে তখন চলাফেরাই হত মুসকিল। মস্ত উঠোনে ঠেলাঠেলি ভিড়। আর, ভিতরের সাজঘরে চিন্তিত মুখে পায়চারি করতেন রবীন্দ্রনাথ। অভিনয়ে পাছে কোনো ভুল হয়!
এমন ইতিহাস বাংলার আর ক’টা নাট্যশালার আছে বলুন তো?
ছবিসূত্র: বিশ্বরূপ গাঙ্গুলী, উইকিমিডিয়া কমনস।