No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    কেশব সেনের ঘটকালিও করেছিলেন কিংবদন্তি অংকের শিক্ষক যাদব চক্রবর্তী

    কেশব সেনের ঘটকালিও করেছিলেন কিংবদন্তি অংকের শিক্ষক যাদব চক্রবর্তী

    Story image

    ছোটবেলায় অঙ্কে ভয় ছিল খুব। বিশেষত পাটিগণিত। তৈলাক্ত বাঁশে পিছলে পড়তে পড়তে, চৌবাচ্চার জলে বুদ্ধি ডুবিয়ে প্ৰতিদিন কাটতো দুইটি ঘণ্টা। লসাগু-তে ভুল করলেই জুটত স্কেলের বাড়ি। আর কী কঠিন কঠিন গুণ-ভাগ! বাপরে! বাবা লাল মলাট দেওয়া একখানা মোটা বই থেকে অঙ্ক দিতেন। ওঁদেরও নাকি ছোটোবেলার বই। ‘যাদব-বাবু’র ‘এরিথমেটিক’। ক্লাস ফাইভ-সিক্স-সেভেনের বাজারে তখনও চিরন্তন কেসি নাগ। কিন্তু বাবা ছিলেন খানিক পুরোনোপন্থী। এরিথমেটিক মানেই যাদব চক্রবর্তী। এলজেব্রা মানে কেপি বসু। বাবার মতে কেশব নাগ নাকি তুলনায় ‘সহজ’। আর ‘ভালো ছেলেদে’র তো কঠিন অঙ্কই সলভ করা উচিত। সেই থেকে চক্রবর্তী মহাশয়ের সঙ্গে আমার চিরকালীন শত্রুতা...

    ১৮৯০ সালে প্রকাশিত ‘এরিথমেটিক’ আমার মতো ফাঁকিবাজদের দু’চোখের বিষ। সুতরাং তা সেকালের দুঁদে অঙ্কস্যারদের প্রিয় হওয়া স্বাভাবিক। শোনা যায়, শান্তিনিকেতনের কিংবদন্তি শিক্ষক জগদানন্দ রায় ক্লাস নিতে নিতে হঠাৎ রেগে গেলে, ছুঁড়ে মারতেন ‘পাটিগণিত বই’। কারো দিকে তাক-করে মারতেন না যদিও। কারণ ওই ‘থান-ইট’ মাথায় লাগলে পতন ও মূর্ছা অবশ্যম্ভাবী। গল্প আছে সিরাজগঞ্জ অঞ্চলের স্কুলের ছেলেরা অঙ্ক পরীক্ষা দিতে যাওয়ার আগে ওঁর বাড়ির মাটিতে পেন্নাম ঠুকে যেত। ব্রিটিশরাও বেজায় ভক্তি করত তাঁকে। গণিতশাস্ত্র আবার  চামড়ার রঙে বাছ বিচার করেছে কই?

    কিন্তু যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী মানুষটা ছিলেন কেমন? বাবাকে হারিয়েছেন সেই ছোট্টবেলায়। সেই পুববাংলায় পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ শহর থেকে কিছু দূরের তেঁতুলিয়া গ্রামের ছেলে। পরিবারের ছয় ভাইবোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো। সংসারের হাল ধরতে হয় ছোট্ট বয়সে। চূড়ান্ত অনটন যদিও টলাতে পারেনি তাঁকে। জলপানির জোরে পার করছেন একের পর এক মাইল ফলক। বিশেষত জটিল অঙ্ক তাঁর কাছে জলবৎ-তরলং। 

    সেকালে মধ্যবৃত্তি নামক এক বিষম কঠিন পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন রাজশাহী ডিভিশনে। তারপর ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রান্স পাশ, আর কলকাতার জেনারেল এসেম্বলিজ ইনস্টিটিউশন ওরফে  স্কটিশচার্চ কলেজ থেকে ১৮৮০ সালে স্নাতক। সবই প্রথম বিভাগে। সেকালে গ্রাজুয়েট হওয়া ছিল বেশ বড়ো ব্যাপার। সহজেই অধ্যাপনার চাকরি মিলে যাবে। কিন্ত অঙ্কপাগল যাদব চেয়েছিলেন আরো জ্ঞান অর্জন করতে। প্রেসিডেন্সি কলেজে এম-এ ক্লাসে ভর্তি হয়ে গেলেন রাতারাতি। বিত্তবানের কলেজ প্রেসিডেন্সি, মাইনে দিতেই কালঘাম ছুটত দরিদ্র যাদবের। পড়ার খরচ যোগাড় করতেই ক্যাথিড্রাল মিশনে অস্থায়ী শিক্ষকতা চালিয়েছেন। একসময় টপকে গেলেন এম এ’র বেড়া। সত্যি হল স্বপ্ন। 

    কিংবদন্তি সৈয়দ আহমেদ সাহেব শুনেছিলেন তাঁর কথা। দেখামাত্রই  নিয়ে এলেন আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে। দীর্ঘ ২৮ বছর সেখানে অধ্যাপক ছিলেন যাদব। পড়াতে পড়াতেই লিখেছেন পাটিগণিত, বীজগণিতের বই। যা  অনূদিত হয়েছিল নানা ভাষায়। 

    ধর্মের রেষারেষি অন্যদের মাথায় থাকলেও, যাদবের তা ছিল না। এক জায়গায় নাকি রসিকতা করে বলেছিলেন, “দীর্ঘদিন এখানে থেকে আমি অন্তরে মুসলমান হয়ে পড়েছি...” 

    যাই হোক, অবসর নিয়েই ফিরে এলেন সিরাজগঞ্জে। সেখানে থাকাকালীন পৌরপিতার দায়িত্ব সামলেছেন। গড়েছেন ইস্কুল, নাট্যমঞ্চ। তারপর দেশভাগের আগেই চলে এসেছিলেন কলকাতায়। শেষজীবনটা সেখানেই...

    তবে তাঁর জীবনে এক ‘কেশব’ এসেছিলেন। ইনি অবশ্য বাংলার নবজাগরণের একজন মুখ, ব্রহ্মানন্দ কেশবচন্দ্র সেন। কুচবিহারের মহারাজা নৃপেন্দ্রনারায়ণের সঙ্গে বিয়ে ঠিক হয়েছিল কেশবচন্দ্রের কন্যা সুনীতি দেবীর। ঘটকের নাম যাদবচন্দ্র চক্রবর্তী। বিবাহের জটিল অঙ্কও বেশ ভালো কষতেন তিনি... বলাই বাহুল্য !

    তথ্যসৌজন্য: বাঙালি চরিতাভিধান, লীলা মজুমদার, তৌসিফ  রহমান, ডক্টর এম.এ পাঠান।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @