‘সুলেখা’ – স্বদেশি আন্দোলন ও বাঙালির চেতনায় গভীর দাগ ফেলেছিল যে কালি

ফেলুদা চিঠিটা পড়ে খাটের পাশের টেবিলের উপর রাখা সুলেখা ব্লু-ব্যাক কালিটার দিকে এক ঝলক দেখে নিল। চিঠিটা মনে হয় সেই কালিতেই লেখা।
যারা সত্যজিতের ফেলুদা সমগ্র গুলে খেয়েছে, তারা চট করে ধরে ফেলতে পারবে উল্লিখিত বাক্য দুটি টান-টান গোয়েন্দাকাহিনি ‘সমাদ্দারের চাবি’ থেকে নেওয়া। যদিও এই লেখার সঙ্গে সত্যজিৎ, ফেলুদা বা গোয়েন্দাকাহিনির কোনও সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক রয়েছে সুলেখা—‘সুলেখা কালি’র। এ কালির কথা উঠলে বাঙালি নস্ট্যালজিক না হয়ে পারে না এমনই তার ইতিহাস, বিস্তৃতি। শুধু বাংলা নয়, দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে স্বদেশী আন্দোলন ও বাঙালির চেতনায় বলা ভালো বাঙালির ‘ব্যবসায়িক’ চেতনায় গভীর দাগ ফেলা এই ফাউন্টেন পেনের কালির রোমাঞ্চকর সব কাহিনি।
ইংরেজদের অত্যাচার থেকে মুক্ত হওয়ার ব্রত নিয়ে সারা দেশে তখন ধীরে ধীরে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে স্বদেশি আন্দোলনের আগুন। ১৯৩০-১৯৩৪ সাল। স্বাধীনতা পেতে দেশ তখন ফুঁসছে। আগেই ব্রিটিশদের তৈরি জিনিস বয়কট করার ডাক দিয়েছিলেন নেতারা। সেই সময় চিঠিপত্র লেখা ও অন্যান্য দরকারী কাজ সারার জন্য ব্যবহার করতে হত বিদেশি কালির ঝর্না কলম। এর থেকে পরিত্রাণ পেতে চাইছিলেন গান্ধিজি। মেঘ চাইতে চাইতে জলও পেয়ে যান তিনি। সেই সময়ই রাজশাহীর স্বাধীনতা সংগ্রামী অম্বিকা চরণ মৈত্র এবং সত্যবতী মৈত্রের দুই সন্তান, ননীগোপাল এবং শঙ্করাচার্য মৈত্র বাবা-মায়ের আদর্শকে পাথেয় করে গান্ধিজির সঙ্গে যোগ দেন স্বদেশি আন্দোলনে। গান্ধিজির স্বদেশি শিল্প গড়ার ডাকে সাড়া দিয়ে, তাঁর অনুপ্রেরণাতেই স্বদেশি জিনিস তৈরির ব্যবসায় যুক্ত হন তাঁরা এবং ১৯৩৪ সালে রাজশাহীতে সূচনা হয় ‘সুলেখা ওয়ার্কস’-এর। কুইঙ্কের মতো ব্রিটিশ কালির বিরুদ্ধে ‘সুলেখা কালি’ হয়ে ওঠে স্বদেশি আন্দোলনের প্রতীক।
সুলেখার বিজ্ঞাপনে গান্ধিজি
আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র তাঁর সহকারী তথা বেঙ্গল কেমিক্যালস-এর চিফ কেমিস্ট তথা মুক্তিযোদ্ধা সতীশ চন্দ্র সামন্তকে এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে বলেন। তিনিই ল্যাবে তৈরি তাঁর ‘কৃষ্ণধারা’ কলমের কালি তৈরির ফর্মুলা তুলে দেন ননীগোপালের হাতে। তৈরি হয় আমদানি করা বিদেশি কালির সঙ্গে টেক্কা দিতে পারে এমন কালি। মৈত্র পরিবারের সকলে মিলে এই কালির ব্যবসায় অংশগ্রহণ করেছিলেন, বাড়ির মেয়েরা কালি তৈরি করতেন আর পুরুষরা সেগুলো ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন। বন্ধু হেমেন্দ্র মোহন বোসের অনুরোধে সুলেখা কালির বিজ্ঞাপনের জিঙ্গেলে লিখেছিলেন, “সুলেখা কালি। এই কালি কলঙ্কের চেয়েও কালো।” এমনকি শোনা যায় সুলেখা কালির নামকরণের পিছনেও নাকি রবীন্দ্রনাথের ভূমিকা ছিল।
সুলেখার বিজ্ঞাপনে বিধানচন্দ্র রায়
গান্ধিজি থেকে শুরু করে ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাই, পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায় ব্যবহার করতেন এই কালি। সত্যজিৎ রায় এই কালি শুধু ব্যবহারই করেননি, তাঁর ফেলুদা সিরিজে এবং সিনেমায় এই কালি-কে বিশেষ স্থান দিয়েছেন।
‘জন অরণ্য’ (১৯৭৬) ছবিতে সুলেখা কালি
ননীগোপাল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা ছেড়ে কলকাতায় এসে পাকাপাকি ভাবে পেনের ব্যবসায় লেগে পড়েন। সুলেখা নামকরণের আগে বাজারে পরিচিতি পেতে শুরু করেছিল ‘প্রফেসর মৈত্রর কালি’। প্রথমত স্বদেশি তার উপর ইংরেজ জব্দ করে ব্যবসা করছে, মৈত্র ভাইদের সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে ওঠে বাঙালি যুবকরা। ১৯৩৮ সালে বৌবাজার এলাকায় একটা বড় কারখানা খোলা হয়। তারপর কলকাতার বাজারের গুরুত্ব বুঝে ১৯৩৯ সালে কসবা ও ১৯৪৬ সালে যাদবপুরে এই কোম্পানি স্থানান্তরিত হয়। এখনও যাদবপুরের ‘সুলেখা মোড়’ এই কালির নামেই শোভা পায়। কোম্পানির শেয়ার হোল্ডারের সংখ্যা ছিল এক হাজারের বেশী। ৬০-এর দশকে আরও দুটি ইউনিট খোলা হয় সোদপুর এবং উত্তর প্রদেশের গাজিয়াবাদে। ভারতে এবং বিদেশেও ব্যবসা শুরু করে সুলেখা।
সুলেখার বিজ্ঞাপনে স্বদেশী ছাপ
অনেক চড়াই-উতরাই, মামলা-মোকদ্দমা, ষড়যন্ত্রের শিকার হয় এই বাঙালি সংস্থা। পরিণতিতে আশির দশকের শেষদিকে বন্ধ হয়ে যায় সুলেখা। ১৯৮৮ সালে প্রথম বার ঝাঁপ বন্ধের আগেই কালির চাহিদা কমতে দেখেছিল সুলেখা। শুরু হয়েছিল বলপেন তৈরি। তবে, হাল ছাড়েনি সুলেখা ওয়ার্কস লিমিডেট। ২০০৬-এ প্রত্যাবর্তন করে এই সংস্থা। সুলেখার বর্তমান ডিরেক্টর কৌশিক মৈত্র (ননীগোপাল মৈত্রের নাতি) একটি বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রকে জানান, নতুন করে ব্যবসা চালুর ক’বছর পরে মূল ব্যবসার পাশাপাশি হোম ও পার্সোনাল কেয়ার (যেমন, সাবান, ন্যাপথালিন, ঘর, মেঝে পরিষ্কারের পণ্য), সৌর বিদ্যুতের সরঞ্জাম ও সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প তৈরিতে পা রেখেছিলেন। কিন্তু ধাক্কা দেয় নোটবন্দি ও জিএসটি। অর্থনীতির দীর্ঘ ঝিমুনিতেও মার খায় ব্যবসা। আর করোনার জেরে দক্ষিণ এশিয়া থেকে সোলার-সেল আমদানি চোট খাওয়ায় বিপদে পড়ে সৌর বিদ্যুৎ প্রকল্প।
কলকাতার দোতলা বাসে সুলেখার বিজ্ঞাপন
হোম ও পার্সোনাল কেয়ারের ব্যবসা শুরুর সময় পাশে ছিলেন ইন্ডিয়ান অয়েলের সিজিএম (এলপিজি) অভিজিৎ দে। তাঁর পরামর্শেই সুলেখা করোনা মোকাবিলার সামগ্রী তৈরিতে নামে ২০২০-তে। হ্যান্ড স্যানিটাইজ়ার তৈরির ড্রাগ লাইসেন্স পায় এপ্রিলে। সৌর প্রকল্প বিভাগের কর্মীরা অফিস, স্কুল, বাড়ি স্যানিটাইজ় করতে সরঞ্জাম তৈরি করেন। হাওড়া, মহেশতলায় তৈরি হয় পিপিই। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তনী হিসেবে সেখানকার ইনকিউবেশন সেন্টার ‘কাস্টের’ পরিকল্পনায় তৈরি মাস্কও বিপণন করেন কৌশিক বাবু। তাহলে, সুলেখার কালি কি আর পাওয়া যাবে না?
সুলেখার অভিনব বিজ্ঞাপন
কৌশিক বাবুর কথায়, কালি উত্পাদন তাঁরা বন্ধ করেননি। সেভাবে চাহিদা না থাকায় এটি সীমিত পরিমাণে উৎপাদন করা হচ্ছিল। তবে গত কয়েক বছরে, ঝর্ণা কলম বা ফাউন্টেন পেনের চাহিদা ক্রমশ বেড়েছে কারণ, এর মধ্যে প্লাস্টিক বর্জন এবং ‘আত্মনির্ভরতা’র একটা ঢেউ ওঠে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অতীতে সুলেখার কালি ব্যবহার করেছেন, এরকম বহু মানুষ তাঁদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাই তাঁরা ঠিক করেছেন সুলেখা কালি মার্কেটে ফিরিয়ে আনবেন তাঁরা। বিভিন্ন স্কুলেও যোগাযোগ করেছেন তাঁরা, যাতে ছাত্রছাত্রীরা ফাউন্টেন পেন ব্যবহার করতে উৎসাহীত হয়।
যে সব জিনিস হারিয়ে যায়, তার সবকিছু ফিরে আসে না, কিছু কিছু আসে। যেমন- সুলেখা কালি। আজও স্বমহিমায় চলছে এই প্রতিষ্ঠান। একেই বোধহয় বলে ফিরে আসা!