No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ২২৫ বছর ধরে স্বমহিমায় বেলঘরিয়ার রথযাত্রা

    ২২৫ বছর ধরে স্বমহিমায় বেলঘরিয়ার রথযাত্রা

    Story image

    আঠেরো শতকের শেষের দিক। তখন সবে আলাদা পরিচিতি পেতে শুরু করেছে এই জনপদ। আশেপাশের বিখ্যাত এলাকা – আড়িয়াদহ, আগরপাড়া, পানিহাটি, খড়দহ, নিমতা, বিরাটি, দমদম, বরাহনগরের পাশে একটু-একটু করে জেগে উঠছে গ্রামটিও। এতদিনকার বাসিন্দা বাগদি-কুমোর-জেলে-কৈবর্তদের পাশাপাশি ঘর বাঁধছেন উচ্চবিত্ত লোকেরাও। নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছেন সমাজের। আর, ততদিনে নিজস্ব নামও খুঁজে পেয়েছে গ্রামটি। ‘বেলঘর’। দু-চারজন সাহেবের আনাগোনায়, শোনা যাচ্ছে ‘বেলঘরিয়া’ শব্দটিও।

    তবে, প্রায় দুশো বছর আগেই গ্রামের বাস করতে শুরু করেছিলেন মুখোপাধ্যায়রা, মিত্ররা, রায়চৌধুরীরা। এবং, তার কিছুকাল পরে ঘোষালরাও এসে ঠাঁই গাড়লেন বেলঘরে। আস্তে-আস্তে হয়ে উঠলেন গ্রামের অন্যতম প্রধান পরিবার। এই ঘোষালদের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে বেলঘরিয়ার রথযাত্রার ইতিহাস। আজ সেই অধ্যায়ের দিকেই উঁকি দেওয়া...

    বাংলা ১২০১ সন। ইংরাজি ১৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দ। বালির পাঠকবাড়ির কর্তা হঠাৎ একদিন স্বপ্নাদিষ্ট হলেন। তাঁর প্রতি আদেশ হল – বালিঘাটে, গঙ্গায় নিমকাঠ ভেসে আসবে। সেই নিম কাঠ দিয়ে জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রার মূর্তি তৈরি করে, পাঠাতে হবে বেলঘরিয়ার ঘোষাল পরিবারে। জগন্নাথ সেখানেই রথের পুজো গ্রহণ করবেন এবং উল্টোরথের দিন আবার ফিরে যাবেন বালিতে।

    একই সময়, স্বপ্নাদেশ পান বেলঘরিয়ার ঘোষাল পরিবারের কর্তাও। পিরিতরাম ঘোষাল শুরু করেন পূজার্চনা। এই পিরিতরাম ঘোষাল ছিলেন ঘোষালবংশের দুই বিখ্যাত পুরুষ কালীদত্ত ও কালীপদ ঘোষালের ঠাকুরদা। যাইহোক, আজ থেকে ২২৫ বছর আগে শুরু হয় রথযাত্রা। সে-আমলে রথ থাকত ঘোষাল পরিবারের তত্ত্বাবধানে এবং বিগ্রহ থাকত বালির পাঠক পরিবারের কাছে।

    প্রথমদিকে, রথটি ছিল কাঠের এবং খুব উঁচু। একবার এক দুর্ঘটনায় ভেঙে যায় সেই রথ। সবার মাথায় হাত। কারণ, ঘোষাল পরিবারের আর্থিক অবস্থা তখন খানিকটা পড়তির দিকে। নতুন রথ তৈরি করার যে বিপুল খরচ, তা তাঁদের সামর্থ্যের বাইরে। ঠিক তখনই, ত্রাতা হিসেবে এগিয়ে আসেন এক বৃদ্ধা পরিচারিকা। সারাজীবন ঘোষাল পরিবারেই কাজ করেছেন তিনি। এমন বিপদের দিনে, যে ঘোষালদের সম্মান রক্ষার্থে তিনি বিক্রি করে দেন তাঁর হাতের দুটি সোনার বালা। সেই টাকা দিয়েই তৈরি হয় একটি লোহার রথ। সেই রথ এখনও বের হয় প্রত্যেক রথযাত্রার দিনে...

    এমনই অনেক ঘটনা জড়িয়ে আছে বেলঘরিয়ার রথের ইতিহাসের সঙ্গে। যার খানিকটা মিথ, কিছুটা আবার ঐতিহাসিকভাবে সত্য। অবশ্য, দুশো বছরেরও বেশি পুরনো এমন উৎসবের সঙ্গে যে কল্পনাও মিশে থাকবে, তা বলাই বাহুল্য।

    যখন বালি ব্রিজ তৈরি হয়নি, বালি থেকে বেলঘরিয়ায় বিগ্রহ আনার পথটিও বেশ আকর্ষণীয় ছিল। জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে ঘোড়ার গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে আসা হত উত্তরপাড়া খেয়াঘাটে, তারপর সেখান থেকে নৌকোয় চেপে আড়িয়াদহ ঘাট। আড়িয়াদহ থেকে আবার ঘোড়ার গাড়ি করে বেলঘরিয়ার ঘোষালবাড়িতে। রথের আগের দিন বিগ্রহ চলে আসত বেলঘরিয়ায়। আটদিন কাটিয়ে, উল্টোরথের পরের দিন ফেরত পাঠানো হত আবার। পরবর্তী সময়ে, যখন বালি ব্রিজ তৈরি হয়ে যায়, মোটরগাড়িতে করেই বেলঘরিয়ায় নিয়ে আসা হত বিগ্রহ। গত শতকের মাঝামাঝি সময় পর্যন্তও এই নিয়মই জারি ছিল। তখন মণিলাল ঘোষাল ছিলেন রথযাত্রার প্রধান আয়োজক। দুপুরে ঘোষালবাড়িতে ভোগারতির পর, জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রাকে ফিডার রোড ও বিটি রোডের সংযোগস্থলে রথতলায় নিয়ে গিয়ে রথে বসানো হত। সেখান থেকে বিটি রোড ধরে মতিলাল শীলের ঠাকুরবাড়ি পর্যন্ত যেত রথ। উল্টোরথের দিন ফিরে আসত আবার যথাস্থানে।

    এখন যেখানে ক্ষুদিরাম বসু হাসপাতাল, সে-জায়গাটা ছিল আগে ঘোষালদের মালিকানায়। সারাবছর সেখানেই থাকত রথটি। আস্তে আস্তে লোকমুখে পুরো এলাকাটাই পরিচিত হয় ‘রথতলা’ নামে। একসময় সেখানে শুরু হয় মেলাও। বেলঘরিয়ার রথের মেলা এখন এখানকার অন্যতম প্রধান আকর্ষণ।

    ফিরে যাই পুরনো দিনের কথায়। মণিরাম ঘোষাল একসময় দৃঢ় হাতে পরিচালনা করতেন রথযাত্রার সমস্ত আয়োজন। এরপর দ্রুত বদলাতে থাকে দেশের আর্থিক ও সামাজিক পটভূমি। ঘোষাল পরিবারের হাত থেকে এই রথযাত্রার আয়োজন বিভিন্ন হাত ঘুরে রথতলার ‘ইয়ং ফ্রেন্ডস ক্লাব’-এ এসে থিতু হয়। মাঝে অবশ্য ১৯৪৮ থেকে ১৯৬৬ পর্যন্ত এই রথযাত্রার দায়িত্ব ছিল বেলঘরিয়ারই ছাত্রমঙ্গল সমিতির ওপর। রাধিকারঞ্জন ঘোষালের উদ্যোগে, পাঠক পরিবার ও ঘোষাল পরিবারের সম্মতিক্রমে ছাত্রমঙ্গল সমিতিতেই আসত বিগ্রহ। পূজাও হত সেখানেই।

    সময়ের নিয়মে প্রাচীন ঐতিহ্য হারিয়ে গেছে অনেকটাই। দীর্ঘদিন হয়ে গেল, বালি থেকে আর আসে না বিগ্রহ। জগন্নাথ-বলরাম-সুভদ্রা সারাবছর থেকে যান মতিলাল শীলের ঠাকুরবাড়িতেই। রথের দিন তাঁদের বাইরে আনা হয়। রথটিও, অনেকদিন অবহেলিত অবস্থায় পড়ে থাকত ইয়ং বেঙ্গল ক্লাবের সামনে। ঘোষাল পরিবারের বর্তমান প্রবীণতম সদস্য, বিশ্বরঞ্জন ঘোষাল অনেক চেষ্টা করেও রথটি রাখার জন্য স্থায়ী কোনো জায়গার ব্যবস্থা করে উঠতে পারেননি। অতি সম্প্রতি কামারহাটি পৌরসভার উদ্যোগে একটি জায়গা নির্দিষ্ট হয়েছে রথটি রক্ষণাবেক্ষণের জন্য।

    এখন কামারহাটি পৌরসভা ও ইয়ং বেঙ্গল ক্লাবই মূলত পরিচালনা করে রথযাত্রা ও রথের মেলাটি। তবে, ঘোষাল পরিবারের প্রতিনিধি হিসেবে প্রায়-নব্বই বছরের বিশ্বরঞ্জন ঘোষালের অধিকার ও সম্মান অটুট। প্রাচীন ঐতিহ্যের সঙ্গে বর্তমানের যোগসূত্র হিসেবে, ঘোষাল পরিবারের এই প্রতিনিধিই এখনও স্বমহিমায় বর্তমান। আর রয়েছে সেই রথটি, বছরের পর বছর ধরে বিটি রোড ধরে যা এগিয়ে যায়, চারপাশের মেলা ও জনসমাগম দেখতে দেখতে। পুরনো দিনের কথা কি তারও মনে পড়ে না? সাদামাটা বেলঘর গ্রাম থেকে আজকের জমজমাট ‘বেলঘরিয়া’ হয়ে ওঠার দিনগুলি?

    একমাত্র রথযাত্রাই বোধহয় উত্তর দিতে পারে সবকিছুর... আর কেউ নয়!

    ছবিঋণ – অরিত্র সোম, ইন্টারনেট  
    (গ্রন্থঋণ – বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে / তন্ময় ভট্টাচার্য)
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @