গরিব আদিবাসী কচিকাঁচাদের একটুকরো সব পেয়েছির দেশ 'বাতায়ন'

বাতায়ন। চারদিকে সবুজ মাঠ আর তার মাঝখানে জাহাজের মতো একটা বাড়ি। খুশি-জাহাজ..
বাতায়ন শুরু হয়েছিল ২০১৪-তে। হুগলী জেলার খন্যানে। অনেক বিরাট ভাবনা তেমন ছিল না বিশেষ। মূলত, আশেপাশের গ্রামের একেবারে গরিব আদিবাসী বাচ্চাদের বিনা পয়সায় পড়ানো দিয়ে শুরু হয় এর পথচলা। জনা-কুড়ি ছাত্রছাত্রী নিয়ে বাতায়নের চাতালে চলত পড়া। তখন অবশ্য শুধু চাতালটাই ছিল। সে চাতালের একধার জুড়ে রোজই কেউ না কেউ ইঁট দিয়ে, চক দিয়ে রকমারি ছবি আঁকত। ওটাই ছিল সেদিন ওদের পড়ার শেষে নিজেদের পড়া। এখানে কেউ কাউকে বকে না, দোষ দেয় না, অনেক অনেক চাপ মাথার উপর চাপিয়ে দেয় না। শুধু বলে, খুশি থাকো। যেভাবে চলতে ইচ্ছে করে চলো…
বাতায়নের অনুষ্ঠানে
এক এক করে বাচ্চাগুলো বড়ো হয়। প্রায় রোজই কেউ না কেউ তার কোনো বন্ধুকে নিয়ে এসে বলে ‘এ পড়বে’। ব্যাস, সেদিন থেকে সে’ও হয়ে যায় বাতায়নের বন্ধু। এমন করে করে এখন প্রায় আশিজন ছেলেমেয়ে আসে বাতায়নে। তারা পড়ে বিভিন্ন ক্লাসে। ফাইভ, সিক্স, কেউ-কেউ বা মাধ্যমিক দেবে। বাতায়নে এখন ৬-৭জন পড়াই। রোজকার সিলেবাসের পড়া যেমন পড়ানো হয়, তার পাশাপাশি জোর দেওয়া হয় নিজের ভাষাশিক্ষায়, ইংরেজি ভাষা এবং অংকের প্রতি। এখানকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে বর্তমানে একটা বড়ো সংখ্যক মানুষ সাঁওতাল জনগোষ্ঠির। বাতায়নে হড় ভাষা এবং অলচিকি লিপি নিজেদের চর্চা করার উপরেও তাই বিশেষ জোর দেওয়া হয়। যারা বাতায়নে পড়াই, তারা তাদের খুব বেশি হলে একটু সাহায্য করি মাত্র পড়াটা বুঝতে। বাদবাকিটা ওরা নিজেরাই পারে। বাতায়নে একটা পুরোনো হারমোনিয়াম জোগাড় করা হয়েছে, পড়া শেষ হলে সেইটা টেনে বসে সক্কলে মিলে ভাগযোগ করে গান করে। ঐ যে সকলে বাজাচ্ছে এতেই ওদের আনন্দ। গানের ব্যাকরণ নিয়ে ওরা মোটেই ভাবিত নয়। বেস্পতি আর শনিবার করে এখানে খিচুড়ি খাওয়া হয়। সেদিন তো আনন্দ উপচে ওঠে। বাটি চামচ টঙটঙাটঙ করে বাজিয়ে চেঁচিয়ে খিচুড়ি মেঝেতে ফেলে সে এক অস্থির কাণ্ড...
মুক্তপাঠের আসর
বাতায়ন ওদের আরেকটা বাড়ি। নিজের বাড়ির থেকে এখানে বেশি সময় কাটায় পারলে। চারদিকে সবুজের ভিড়ের মধ্যিখানে বাতায়নের ভিতরেও একটা সবুজ মন আছে। কচিগুলো সেটাকে ছুঁতে পারে। সেই সবুজ বেয়েই ওরা গড়াতে থাকে। গড়াতে গড়াতে ওরা ওদের জীবনের সব হার্ডলগুলো টপকে যায়। টপকে যায় সারাদিন নুনভাত খেয়ে থাকার কষ্ট। টপকে যায় বাবা নামের ছাদটার হঠাৎ একদিন নেই হয়ে যাওয়ার কষ্ট। টপকে যায় ক্রমাগত বঞ্চিত হতে হতে নির্লিপ্ত হয়ে যাওয়ার যন্ত্রণাকে। বাতায়ন আসলে একটা সব পেয়েছির দেশ ওদের কাছে।
সেই ২০১৫ থেকেই এখানকার ছেলেমেয়েদের বৃহৎ এই সমাজের আদি সংস্কৃতির সাথে পরিচিত করানোর অভিপ্রায়ে জানুয়ারি মাসে একটা দুদিনের অনুষ্ঠান হয়। তাতে, আবশ্যিকভাবে থাকে এখানকার ছেলেমেয়েদের পার্ফরমেন্স। বেশ কিছু গান আর নাচ। ঐ আদিবাসী গানের তালে পা মেলাবে না, এমন বেরসিক দর্শক কেউ থাকে না ঐ অনুষ্ঠানে। এরপর থাকে ওদের নাটক। দু-তিনটে নাটক হবেই, একটাতে থেমে যাওয়ার পাত্র কেউ নয়। সেসব নাটকের জন্যে তার আগের একমাস ধরে বাতায়নে উৎসব চলে। বাহ! রিহার্সাল চললে তো তাকে উৎসবই বলা হবে। নাটক হয়, মুড়ি-চানাচুর হয়। কোনও কোনোদিন পরোটা। আর সর্বোপরি অফুরন্ত আড্ডা।
বাতায়নের অনুষ্ঠান
অনুষ্ঠানের দিন যেন সবটাই নিখুঁত থাকে, সেদিকে ছেলেমেয়েগুলোর নজর অনেকের থেকে অনেক বেশি। নিছক প্রাইভেট টিউশনি পড়তে আসা থেকে কেমন করে এটা ওদের ভালোবাসা’র ঘর হয়ে উঠলো সেটা অনেকটা একটা ম্যাজিকের মতো। এত প্রতিকূলতা পেরিয়েও ওদের এই হাসিমুখে জীবন কাটানো বাতায়নকে সবসময় উদ্বুদ্ধ করে। পড়ার ফাঁকে রোজকার নাচ-গান-নাটক-হুল্লোড় এগুলো যেন যা কিছুর সম্মুখীন হতে-হতে ওরা যায়, সেগুলোকে ছাপিয়ে যাওয়ার প্রয়াস। বাতায়নের উপর দাঁড়িয়ে ওরা এই গোটাটা করে। বাতায়নের দেওয়াল ভরিয়ে দেয় এঁকে লিখে। ওদের সঙ্গে সঙ্গে বাতায়নও বড়ো হয়। ওরা জানে, অন্যত্র যারা স্টেজ বানায় তারাই সেই স্টেজে উঠে নাটক করে না। যারা ঘর বানায়, তারাই সেই ঘরে বসে গল্প করে না।
বাতায়নের পরিবার
এই পথ চলার জন্যে বাতায়নের যাবতীয় খরচখরচা চলে নিজেদের পকেটের খরচা দিয়ে। এছাড়াও, বাতায়নের বহু বহু শুভাকাঙ্ক্ষী আছেন, তারাও অকুন্ঠে বাতায়নকে সাহায্য করে থাকেন।
বাতায়নের প্রথম ঘর
বাতায়নের জাহাজটাও বড়ো হচ্ছে একটু-একটু করে। চাতালের পরে একটা দরমার ঘর উঠেছিল। সেইটা বছর তিনেক টিকে ছিল ঝড়-জল পেরিয়ে। তারপর ধীরে ধীরে বাড়ি উঠল। এখনকার খুশির জাহাজ-বাড়িটা বানানোর পিছনে এই ছেলেমেয়েদের সাহায্য সবচেয়ে বেশি। ওদের ভালো থাকাকে ওরা নিজেরাই তৈরি করছে। অল্প অল্প করে। নিজেদের সৃষ্টিশীলতাকে হাওয়ায় উড়তে দিচ্ছে। নিজের শর্তে বেঁচে থাকছে। এইভাবেই বাতায়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সব মানুষেরা এতদিনের নৈঃশব্দের সংস্কৃতিতে বেঁচে থাকা থেকে ক্রমে সরবের সংস্কৃতির দিকে যাত্রা শুরু করেছে।
বাতায়ন ব্যস আর কিচ্ছু চায় না।