No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    কর্তাভজাদের বিশ্বাসে চৈতন্যদেব জন্মালেন ফকির ‘আউলচাঁদ’ হয়ে

    কর্তাভজাদের বিশ্বাসে চৈতন্যদেব জন্মালেন ফকির ‘আউলচাঁদ’ হয়ে

    Story image

    সে অনেককাল আগের কথা। কম করেও তিনশো বছর তো হবেই। কেউ কেউ অবশ্য নির্দিষ্ট করে বলেন ১৬৯৪ সাল। উলা বীরনগরে মহাদেব বারুই নামে এক বৈষ্ণব পানচাষি ছিলেন। একদিন তাঁর পানের বরজে দেখা মিলল একটি অপরূপ শিশুর। জ্যোৎস্নায় চাঁদ যেমনটি হয়, তেমন গায়ের রং। কে এই শিশু? খোঁজ মেলে না। শিশুটির নাম রাখা হল পূর্ণচন্দ্র। এই পূর্ণচন্দ্রই পরবর্তীকালে ফুলিয়ার বলরাম দাসের কাছে দীক্ষা নিলেন। তাঁর নাম হল আউলচাঁদ। এরপর, ধর্মপ্রচারের উদ্দেশে বেরোলেন আউলচাঁদ। নানা জায়গায় ঘুরে এসে পৌঁছলেন অধুনা কল্যাণীর ঘোষপাড়ায়। ততদিনে ‘ফকির ঠাকুর’ আউলচাঁদের অলৌকিক ক্রিয়াকলাপের কথা ঘুরছে মানুষের মুখে-মুখে। ভক্তদের স্থির বিশ্বাস, তিনি সাধারণ মানুষ নন, স্বয়ং চৈতন্যদেবই জন্মান্তরে হয়ে উঠেছেন আউলচাঁদ।

    এই আউলচাঁদ ঠাকুরই কর্তাভজা সম্প্রদায়ের আদিগুরু। কর্তাভজারা ঠিক বাউল নন, তবে তাঁরা দেহসাধনায় বিশ্বাসী সম্প্রদায়। কর্তা অর্থাৎ ঈশ্বর আর ভজা অর্থে শরীর। নামের মধ্যেই নিহিত দেহতত্ত্বের আভাস। জনশ্রুতি, কিংবদন্তি, লোকমুখে ছড়িয়ে থাকা নানা গল্পে গড়ে উঠেছে কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ইতিহাস। আর লোকবিশ্বাসের এই পরম্পরাতেই কর্তাভজাদের আদিগুরু আউলচাঁদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছেন চৈতন্যদেবও। 

    লোকবিশ্বাস অনুযায়ী, বিষ্ণুপ্রিয়ার অভিশাপেই আবার জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল চৈতন্যদেবকে। দীর্ঘদিন ধরেই বাউলদের বিশ্বাস, স্বয়ং চৈতন্যদেবের নাকি একটি গূহ্য পরকীয়া মৈথুনাত্মক সাধন প্রণালী ছিল। শুধু চৈতন্যদেবই নন, রূপ, সনাতন, নিত্যানন্দ, জীব প্রমুখ সাধকদেরও পরকীয়া সঙ্গিনী ছিল। চৈতন্যদেব আউলচাঁদ রূপে জন্ম নিয়ে এই গূহ্য সাধন প্রণালীই সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করেন। এই আউলচাঁদই কর্তাভজাদের ‘কর্তা’। অপর একটি মত অনুযায়ী, আউলচাঁদ ঠাকুরের জন্ম মুসলমানের গৃহে। চৈতন্য, ইসলাম, দেহতত্ত্ব একাকার হয়ে যায় এই জনশ্রুতিতে, লোকবিশ্বাসে।

    এর পরের কাহিনিতেও বিস্ময় কম নেই। আউলচাঁদ ঘোষপাড়ায় এসে বসলেন ডালিমতলায়। রামশরণ পাল সে-অঞ্চলের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি। তাঁর স্ত্রী সরস্বতী দেবীর তখন মৃতপ্রায় অবস্থা। পাশেই পুকুর হিমসাগরের জলে ডালিমতলার মাটি মিশিয়ে সরস্বতীর সারা গায়ে লেপে দিলেন আউলচাঁদ। মৃত্যুমুখ থেকে প্রাণ ফিরে পেলেন সরস্বতী। এই সরস্বতী দেবীই কর্তাভজাদের ‘সতীমা’। রামশরণ-সরস্বতী সহ ২২ জনকে দীক্ষা দিয়েছিলেন আউলচাঁদ। রামশরণ ও সরস্বতী আউলচাঁদকে স্থায়ীরূপে কামনা করেছিলেন। তাঁদের পুত্র রূপে জন্মাবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঘোষপাড়া থেকে বিদায় নেন আউলচাঁদ। কথিত,  ১৭৬৯ সালে আউলচাঁদের মৃত্যু হয়। এর কিছুকাল বাদেই সতীমা-র গর্ভে জন্ম দুদালচাঁদের।  দুলাল যেহেতু আউলচাঁদেরই স্বরূপ, তাই লোকবিশ্বাসে দুলালচাঁদও চৈতন্যের অবতার। তাঁর আমলেই কর্তাভজা সম্প্রদায়ের ব্যাপক প্রসার ঘটে, কর্তাভজাদের পরম উৎসব ‘সতীমার মেলা’-র জন্মও দুলালচাঁদেরই আমলে।

    বিশিষ্ট পণ্ডিত ও গবেষক আহমেদ শরীফ কর্তাভজাদের মতোই আরেকটি সম্প্রদায়ের উল্লেখ করেছেন, যে-শাখার প্রবর্তক ছিলেন মাধব বিবি। এই মাধববিবি নাকি ছিলেন আউলচাঁদের শিষ্যা। আর, মাধববিবির শিষ্য নিত্যানন্দ-পুত্র বীরভদ্র বা বীরচন্দ্র এই সম্প্রদায়ের দেহসাধনতত্ত্ব জনপ্রিয় করেছিলেন। ইতিহাস বা জনশ্রুতি, যা-ই হোক না কেন, এই কাহিনিগুলির ভিতরে সমাপতিত হয়ে গেছে বৈষ্ণব ঐতিহ্য এবং ইসলাম। সঙ্গে এসে মিশেছে দেহসাধনার গূহ্যপথ। এ এক আশ্চর্য পৃথিবী। বাংলাদেশ এমন কত যে সংমিশ্রণের জন্মদাত্রী।

    আজো ‘কর্তা’-র অলৌকিক কাহিনিরা ঘুরে বেড়ায় কর্তাভজাদের মুখে-মুখে। দোলপূর্ণিমায় সতীমার মেলাতে ভিড় করেন হাজার হাজার মানু্ষ। কল্যাণী সীমান্তগামী ট্রেনে ঘোষপাড়া স্টেশন নামতেই টের পাওয়া যায় উৎসবের আমেজ। এখান থেকে সতীমায়ের মন্দির কিলোমিটার দুয়েক। কিন্তু প্ল্যাটফর্মের চৌহদ্দি ছাড়িয়ে বেরোতেই চোখে পড়ে দোকানে-দোকানে হরেক পসরা। কানে আসে দেহতত্ত্বের গান—“‘এ ভাবের মানুষ কোথা থেকে এল। এর নাইকো রোষ, সদাই তোষ”। মেলা-প্রাঙ্গনে উড়ে বেড়ায় আবির। দূর-দূরান্ত থেকে দুরারোগ্য অসুখে আক্রান্ত মানুষরা আসেন হিমসাগরের জলে একবার ডুব দিয়ে সুস্থ হওয়ার আশায়। কর্তার পাশাপাশি সতীমা-কে ঘিরেও অনেক অতিলৌকিক কাহিনির ভিড়। পালবংশ এখন ভেঙে গেছে একাধিক শরিকে। কিন্তু এখনো ‘দেবমহন্ত’, ‘মহাশয়’ এবং ‘বরাতি’-দের মধ্যে সাধন-প্রণালীর বিনিময় বন্ধ হয়নি। মুছে যায়নি জনশ্রুতি, লোকবিশ্বাস আর বিস্ময়ের পৃথিবীটাও।

    এইসব কাহিনি, বিশ্বাসকে আপনি নাকচ করতেই পারেন চাইলে, কিন্তু সম্মিলনের এই আশ্চর্য আখ্যান কিন্তু আপনাকে টানবেই। বিচ্ছিন্নতার বয়ান যত তীব্রতর হচ্ছে এই বাংলায়, ততই যেন বাংলার ধর্মীয় সম্মিলনের বার্তা বয়ে এনে আরো প্রতীকী হয়ে উঠছে ‘সতীমা’-র মন্দির, কর্তভজাদের মতো অসংখ্য সাধন-সম্প্রদায়ের ইতিহাস। সেখানে ভাবের মানুষের ভজনা। তার দোষ-রোষ কিচ্ছু নেই। এও তো আমাদেরই বাংলা।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @