নগ্নতাও অস্ত্র, রক্ষণশীল শিল্প-সমাজের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে হেমেন্দ্রনাথের ক্যানভাস

১৮৬৫ সালে, পারি-সালনে ঝুলছিল একটি ছবি। বিছানায় শুয়ে একটি নগ্ন নারীদেহ। কামাতুর চোখের ইশারা। একটি হাত আলগোছে বালিশে রাখা। অন্য হাতটি... সামান্য গাঢ় রং ভেদ করে শ্বেতাঙ্গ সুন্দরীর বিছানায় একটি গোলাপের তোড়া রাখছে এক কৃষ্ণাঙ্গ ‘বাঁদি’। দেহপসারিনীর চরণতলে পড়ে কোনো এক প্রেমপাগলের উপঢৌকন। ছবির নাম, ‘অলিম্পিয়া’। শিল্পী, এডওয়ার্ড মানে। পারির সংস্কৃতি-মহলে সেদিন ছিছি পড়ে গিয়েছিল। কারণ, এতকাল ‘ন্যুড-স্টাডির’ মূল উদ্দেশ্যই ছিল অবিনশ্বর দেবতাদের রূপায়ণ। সেখানে কিনা...
হেমেন মজুমদারের নাম শুনলেও তখনকার গোঁড়া শিল্পরসিকদের মুখে খেউরের বন্যা বইত। “যিনি সিক্তবসনা সুন্দরী এঁকে বিখ্যাত”, সমাজের চোখে তাঁর তুলিটি লাগামছাড়া। তাঁর ‘সুন্দরী’রা যেন বড়ো বেশি ‘বিদেশি’। বলা ভালো ‘ইউরোপীয়’।
আরো পড়ুন
যখন ‘আরব্য রজনী’ আঁকলেন অবনীন্দ্রনাথ
হেমেন্দ্রনাথ মজুমদার, বাংলার শিল্পীমহলে নাম-কাটা সেপাই। হ্যাভেল এবং অবন ঠাকুরের নেতৃত্বে যখন ‘ওরিয়েনটাল আর্টে’-র বাড়-বাড়ন্ত, ঠিক সেই সময়েই গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ ছেড়ে দিয়ে জুবিলী আর্ট কলেজে ভর্তি হচ্ছেন তিনি। এই আর্ট একাডেমির মুষ্টিমেয় ছাত্ররা তখনো ছিলেন খানিক প্রাচীনপন্থী। তাঁদের ছবি ইউরোপীয় ঘরানার। মূলত রণদাপ্রসাদ গুপ্তর নেতৃত্বে গড়ে উঠছিল জুবিলী। কিশোরগঞ্জের গছিহাটা গ্রামের বাসিন্দা হেমেন ছবি আঁকবেন বলে পালিয়ে এসেছিলেন কলকাতা। দিদি হৈমলতার কাছে। তাঁর জামাইবাবু রমেশ সোম, শ্যালকের আগ্রহ দেখে ভর্তি করে দিলেন গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজে। কিন্ত আর্টস্কুলের বাঁধাধরা শিল্পশৈলী তাঁর হজম হয়নি। বিশেষত পাশ্চাত্য শিল্পকলাকে চরম অবহেলা, মেনে নিতে পারেননি তিনি। বিষিয়ে আসছিল মন। ১৯১১-য় পঞ্চম জর্জের সম্মানার্থে কলকাতায় একটি তোরণ সাজানোর নিয়েছিল গভর্নমেন্ট আর্ট কলেজ। হেমেনের কাছে, শিল্পকলার উদ্দ্যেশ্য শুধুমাত্র রাজরাজড়াদের খুশি করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। ছেড়ে দিলেন কলেজ। শেষদিন পর্যন্ত ছিল ক্ষোভ, যা শোনা যাবে তাঁর জবানিতেই “...কবির কাব্যসৃষ্টি যদি হুকুমের অপেক্ষা রাখে তবে সে কাব্য পড়িবার পূর্বেই অপাঠ্য। তেমনি শিল্পী যদি তাহার শিল্প-নির্মাণ-কার্যে আদেশের অধীন হয় তবে সে চিত্র অঙ্কিত না হইলে ক্ষতি কী?”
আর্ট কলেজ ছাড়ার পর খানিক টানাটানির মধ্যেই পড়লেন। চিত্রকরের জীবন যেমনভাবে চলে। এখানে ওখানে পোর্ট্রেট, থিয়েটারের সাইনবোর্ড আঁকতে আঁকতে, বিভিন্ন দেশি-বিদেশি প্রতিযোগিতায় ছবি পাঠাতে পাঠাতে দিন চলছিল। দিন থেকে মাস, বছর। ১৯১৯ সালে হেমেন গড়ে তুললেন ‘ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ ফাইন আর্টস’। সঙ্গে ছিলেন বন্ধু অতুল বসু, যামিনী রায় এবং ভবানীচরণ লাহা। চেয়েছিলেন সাধারণ মানুষও ছবি দেখুক। ছবি কি শুধু বিত্তবানদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে নাকি?
কিন্তু স্বদেশি আন্দোলনের যুগে পশ্চিমী শিল্পশৈলীর কদর পড়তির দিকে। অবন ও গগন ঠাকুর ফিরেছেন তথাকথিত ‘প্রাচ্য ধারায়’। ভারতের এক প্রান্তে রাজা রবি বর্মা বলে এক ‘ছোকরা’ পাশ্চাত্য কায়দায় ছবি এঁকে জনপ্রিয়তা ও জনরোষ দুইই কুড়োচ্ছেন। অন্যদিকে বেঙ্গল স্কুল প্রায় নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে ফিগার ড্রয়িং। বাঙালির ‘ছবির চশমায়’ একের পর এক বদল ঘটছে। উড়ে এসে জুড়ে বসছে ভিকটোরীয় মূল্যবোধ। কালিদাসীয় নগ্নতা ঢাকা পড়ছে বিদেশি পেটিকোটে।
১৯২৪ সালে অতুল বসু চলে যাচ্ছেন ইংল্যান্ড। ফলে বন্ধ হয়ে গেল ইন্ডিয়ান একাডেমি অফ ফাইন আর্টস। এদিকে ঠাকুরবাড়ির নিয়ন্ত্রণ ভেঙে বেরিয়ে, হেমেন মজুমদারের ছবি জিতে নিচ্ছে একের পর এক ভারতীয় ও আন্তর্জাতিক সম্মাননা। পরপর তিনবার ‘বোম্বে আর্ট সোসাইটি’ থেকে সোনার পদক ছিনিয়ে নিচ্ছেন তিনি। ১৯২১ সালে ‘স্মৃতি’, ১৯২২ সালে ‘বর্ণঝঙ্কার’, আর ১৯২৩ সালে ‘কর্দমে কমল’, ছবিগুলি মন জয় করে নিচ্ছে নির্বাচকদের। ক্ষুব্ধ হয়ে বোম্বে ক্রোনিকালে সাংবাদিক কানহাইয়ালাল ওয়াকিল লেখেন, “কলকাতার এক হেমেন মজুমদার প্রদর্শনীতে তিনবার প্রথম পুরস্কার জিতেছেন। এটা বোম্বের শিল্পীদের জন্য মর্যাদাহানিকর... হয় এই জুরি বোর্ড অযোগ্য নয়তো প্রদর্শনীর জন্য জনাব মজুমদার বেশি যোগ্য।” এছাড়া ‘রোজ-ওর-থর্ন’ কিংবা ‘পল্লী’-সিরিজ, শিল্পরসিকের মনে ফিরিয়ে আনছে ‘রেমব্রান্ট’-কে। ময়ূরভঞ্জের মহারাজা কুড়ি হাজার টাকা দিয়ে কিনছেন হেমেনের ছবি। বিভিন্ন বিত্তশালী শিল্পানুরাগীদের মুখে তাঁর নামটাই শোনা যাচ্ছে।
কিন্তু হেমেন তো কখনো পশ্চিমকে অন্ধভাবে অনুসরণ করেননি। তাঁর তুলি নারীকে ‘পূর্ণ নগ্ন’ হিসেবে দেখায় না। বরং ভেজা কাপড়ের পরতে পরতে যে লাবণ্য ফুটে ওঠে তার আকর রয়েছে বাংলার পল্লিযাপনে। হেমেনের ছবিতে ঠাঁই পেয়েছে মূলত পূর্ণবয়স্কা মহিলারাই। এসব ছবির জন্য ‘মডেল’ নিতেন না তিনি খুব একটা। অনুপ্রেরণা হিসেবে ব্যবহার করতেন ফটোগ্রাফ। বেশিরভাগ সময়ই মডেল হয়েছেন তাঁর স্ত্রী সুধারাণী।
শোনা যায়, তাঁর কিছু ছবির পেছনে অনুপ্রেরণা বঙ্কিমচন্দ্রের উপন্যাস। ‘মানসপ্ৰতিমা’ ছবিটিতে দেখা যাবে পুকুরঘাট কলসী-কাঁখে থেকে উঠে আসছেন এক নারী। সদ্যবিবাহিত হেমেন, নিজের স্ত্রীর স্নান করে উঠে আসার দৃশ্য ক্যামেরাবন্দি করেছিলেন। ফটো থেকে ধার করা সেই অবয়বে বসালেন ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ উপন্যাসের ‘রোহিনীকে’।
বাঙালি রক্ষণশীলদের কাছে হেমেনের ছবি অশ্লীল। কিন্তু যৌনপল্লিতে আড়ালে কড়া নাড়া বাবুসমাজ ভুগতেন অপরাধবোধে। ঘরের এককোনে লুকিয়ে রাখা পত্রিকার পাতা উল্টিয়ে আহরণ করতেন নিষিদ্ধ সুখ। আবার, প্রথম জীবনে রাজরাজড়াদের হয়ে ছবি আঁকা নিয়ে আপত্তি থাকলেও পরবর্তীতে তাঁরাই হয়ে উঠেছিলেন হেমেনের সবচেয়ে বড়ো পৃষ্ঠপোষক।
তবে, সারাজীবন শিল্পের স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দিয়ে এসেছেন হেমেন্দ্রনাথ। তাঁর প্রিয় পশ্চিমী শিল্পরীতিও তো এগিয়েছে সামাজিক গোঁড়ামির সঙ্গে বিরামহীন সংঘাতের মাধ্যমেই। হেমেন তাঁর স্টুডিওতে কাজ করে যেতেন অবিরাম। মাঝেমধ্যে বেরোতেন শিকারে। কলকাতার ‘এন সি ড’ থেকে গুলি-কার্তুজ সংগ্রহ করতেন নিয়মিত। অল ইন্ডিয়া এক্সিবিশনের জন্য আঁকতে আঁকতে স্বাধীনতার একবছর পরেই চলে গেলেন, ‘ছক ভাঙতে চাওয়া’ হেমেন মজুমদার ।
ঋণ : চিত্রশিল্পী হেমেন মজুমদার, বারিদবরণ ঘোষ; রূপাঞ্জন গোস্বামী