সব সাপ বিষাক্ত নয়, কুসংস্কার মুছে বাঙালিকে সাপ চিনতে শিখিয়েছিলেন যে বিস্মৃত মানুষটি

শীতকাল এসে পড়ল বলে। তবুও সাবধানে মার নেই। ক’দিন আগেই প্রবল বৃষ্টিতে বুজে গিয়েছে গর্তগুলো। আলের ধার ধরে তাই প্রায় প্রাণটি হাতে করে চলতে হয়। সঙ্গে টর্চবাতি থাকা ভালো। আর একখানা লাঠি। ঠুকে ঠুকে বলতে হয়, “লতা লতা লতা...” কানিমনসার কৃপায় ‘তেনারা’ সরাৎ সরাৎ লুকিয়ে পড়েন ঝোপে। লেজে পা পড়লে মা কুপিত হবেন যে। সামান্য ফোঁস! তারপর ডাকো গুনিন, আনো বিষপাথর!
গেলবার হারুদা পুকুরে চান করতে গিয়ে কামড় খেলো জলঢোঁড়ার। দিনটা ছিল শনিবার। শাস্তরের অমোঘ বাণী হারুদার মনে ছিল। “শনি আর মঙ্গলে ঢোঁড়ার দাঁতে বিষ !” আর যায় কোথায়? ভয়ে প্রাণপাখি উড়ে গেল ওর। হাসপাতাল নিয়ে যাওয়ার আগেই হার্টফেল করে পটল তুলল হারাধন দাস।
আরও পড়ুন
বঙ্গদর্শন পুজোসংখ্যা, ১৪২৬
শস্যশ্যামলা বঙ্গমায়ের কোল একসময় ছিল মনসার সন্তানদের অবাধ বিচরণক্ষেত্র। মূলত তিন ধরনের গোখরো, শঙ্খচূড়, শাঁখামুটি, কালাচ আর চন্দ্রবোড়া ছাড়া মানুষের প্রাণ নিতে অধিকাংশই অক্ষম। তবে সাধারণ মানুষকে কে বোঝাবে সেকথা? আমাদের তো জানা, ‘বিষহীন’ কালনাগিনীর এক কামড়ে মরেছিল লখিন্দর। গল্পে সিনেমায় এরা শয়তানের দূত। এদের দৌলতে ওঝা-গুনিনদের দাপট প্রবল। অধিকাংশ গ্রামেই ডাক্তার নেই, নেই ভালো হাসপাতাল। রয়েছে অন্ধবিশ্বাস...
আরও পড়ুন
পলিফ্লাওয়ার থেকে ‘ব্যানার্জিস পালং-- মানবজমিনেও সোনা ফলাতেন প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র শিবপ্রসাদ
তবে হাল আমলে নানা সরকারি-বেসরকারি সংস্থা আজকাল সাপের ভয় থেকে মুক্ত করছেন গ্রামবাসীদের। কুসংস্কারবিরোধী যেকোনো উদ্যোগই আজ ইন্টারনেটের যুগে সুদূরপ্রসারী। তবে বছর সত্তর আগে, ব্যাপারটা মোটেই তেমন ছিল না। ডাক্তারের থেকে গুনিনদের কথার মূল্য ছিল বেশি। আর যুক্তিবাদী মানুষমাত্রেই ধরা হতো ‘পাগল’।
এমনই এক পাগলের নাম অবনীভূষণ ঘোষ। চরিতাভিধানে তাঁর নাম পাওয়া দুষ্কর। অথচ তিনিই তো সাপের ভয় নিয়ে লেখার পর লেখা লিখেছেন পত্রপত্রিকায়। কুসংস্কারমুক্ত সমাজ গড়তে ছুটেছেন গ্রামে গ্রামে। হাতেকলমে ধরে দিয়েছেন সাপুড়েদের বুজরুকি। বিদেশ গেলে, দুটো পেপার লিখলে হয়তো বাঙালি মনে রাখত...
১৯১৪-তে জন্মেছিলেন অবনীভূষণ। কলকাতাতেই। বাবা ছিলেন ছোটোখাটো একটা জমিদারির শরিক। ভবানীপুরে বাসা ছিল তাঁদের। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে চতুর্থজন অবনীভূষণ। তবে রুপোর চামচ মুখে জন্মালেও সে সুখ বেশিদিন থাকেনি। অবনীভূষণের ছাত্রাবস্থাতেই চলে গিয়েছিল জমিদারি। শরিকি ঝামেলায় বেহাত হয়ে যায় বসতবাড়িটিও। গ্রাজুয়েট হয়েই চাকরির সন্ধানে বেরিয়ে পড়েছিলেন তিনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এয়ার রেড প্রিকশনের চাকরি নিয়েছিলেন। তারপর সাংবাদিকতা করেছেন দীর্ঘদিন। ‘মাতৃভূমি’ কাগজে। উপার্জনের জন্য বেনামে লিখেছেন পাঠ্যবই। বাংলা-ইংরেজিতে সমান দক্ষ ছিলেন। তাছাড়া ভূগোল, ইতিহাস-সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি সিলেবাস ধরে লিখতে তাঁর জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু প্রচারবিমুখ অবনীভূষণকে ঠকিয়েছেন বহু প্রকাশক। গ্রন্থস্বত্ব দূরের কথা, নামটিও ওঠেনি প্রথম পাতায়।
কলকাতার আশে পাশে মূলত দক্ষিণদিকের জংলা সোনারপুর, বারুইপুর ইত্যাদি গ্রামগুলোয় ঘুরতে ঘুরতে অবনীভূষণ দেখছিলেন, একটা আপাত নিরাপদ প্রাণীকে নিয়ে সবাই কেমন দিশেহারা। অসহায় গ্রামবাসীদের ঠকিয়ে দু’পয়সা করে নিচ্ছে ওঝার দল। পত্রপাঠ কলম ধরলেন তিনি। একের পর এক প্রকাশিত হতে লাগল লেখা। যার মধ্যে, ‘সাপ’, ‘সাপ নিয়ে কিংবদন্তি’, ‘সাপের কথা’, ‘ডাক্তার আসার আগে’-র মতো বইকে দুর্লভ বলা চলে। এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার পেয়েছিল কয়েকটি বই।
প্রচলিত কুসংস্কারগুলি ভেঙে ফেলে, প্রাণীটাকে নতুন চোখে দেখতে শিখিয়েছিলেন তিনি। সাপের মাথার মণি, গোখরোর গরুর বাঁট থেকে দুধ খাওয়া, বিনের সুরে বশ মানা-- সবই নস্যাৎ করেছেন অবনীভূষণ। এমনকী সাপে কাটার পর প্রাথমিক চিকিৎসাও বাতলেছেন তাঁর লেখায়। বিশ্বায়নের যুগে দাঁড়িয়ে সে লেখা পড়লে, তথ্যের ভুলভ্রান্তি দেখে হয়তো পাঠকের হাসিই পাবে। কিন্তু এটাও মাথায় রাখা উচিত, সে-যুগে ইন্টারনেট ছিল না। আর অবনীভূষণ পাশ করা সর্পবিশারদও নন। যা কিছু শেখা, তা নেহাতই পঞ্চেন্দ্রিয়র সদ্ব্যবহারে।
শুধু লিখেই নয়, হাতেকলমে, জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বুজরুকি ধরে দিয়েছেন অবনীভূষণ। তার বিবরণও পাওয়া যায় একটি লেখায়-- “সর্প গবেষণার একদম শুরুতে, শাঁসালো খদ্দেরদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে মাছ-ব্যবসায়ী অনেক সময় দুহাত যুক্ত করে তার জিয়ল মাছগুলোকে তার সামনে তুলে ধরে। কোনো সাপুড়েকে কোথাও খেলা দেখাতে দেখলে তেমনি আমিও তার সাপগুলোকে অবলীলায় দুহাতে করে নিয়ে উপস্থিত দর্শকদের সামনে তুলে ধরতাম। উদ্দেশ্য ছিল মহৎ ও স্পষ্ট---- সাপুড়ে ও উপস্থিত ব্যক্তিদের চোখ ট্যারা করে দেওয়া। ট্যারা করে দিতাম ঠিকই, কিন্তু আজ বুঝতে পারি, ঐ কাজে কী মারাত্মক ঝুঁকি ছিল ! বহু সাপুড়ের মত অঙ্কুর বিষদাঁতের কথা তখনও আমি জানতাম না।”
বই থেকে বেতারেও পৌঁছেছিলেন ছিলেন তিনি। বিজ্ঞানবিষয়ক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডাক পড়ত তাঁর। সহজ ভাষায় শ্রোতাদের কৌতূহল মেটানো, মানুষের মন থেকে কুসংস্কার দূর করা ছিল তাঁর জীবনের ব্রত।
এহেন মানুষটি শেষবয়সে বিজ্ঞানপ্রচারের ঢক্কানিনাদে হারিয়ে যাবেন, সেটাই হয়তো স্বাভাবিক। হাজরা রোডের একটা ঘরে মলিন তক্তাপোষে চলচ্ছক্তিরহিত অবনীভূষণ মৃত্যুর দিন গুনেছিলেন। ইলেকট্রিক বিল তো দূরের কথা, চশমাটুকু সারানোর পয়সাও ছিল না...
বাংলা থেকে দীপক মিত্রের মতো সর্পবিশারদদের সংখ্যা কম নয়। বিজ্ঞানমনস্ক-কুসংস্কার বিরোধী আন্দোলনের কর্মীরাও কাজ করে চলেছেন জেলায় জেলায়। চক্ষুর অগোচরে হারিয়ে যাওয়া অবনীভূষণ হয়তো তাঁদের মধ্যেই এখনো জীবিত।
ঋণ: রণতোষ চক্রবর্তী , ‘সাপের কথা’, অবনীভূষণ ঘোষ,
অবণীভূষণের ছবি: রণতোষ চক্রবর্তীর লেখা ‘তিন অবহেলিত জ্যোতিষ্ক’ থেকে।