No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    বাংলায় পাথরের মন্দির

    বাংলায় পাথরের মন্দির

    Story image

    কবি রামপ্রসাদ গেয়েছিলেন-

    আমার মাটির ঘরে বাঁশের খুঁটি মা
    পাই যেন তায় খড় জোগাতে মা …
     আমার মাটির ঘর যে সোনার ঘর মা ।।

    বাঙালির নিজস্ব গৃহস্থাপত্য বলতে মাটির ঘরে বাঁকানো খড়ের চাল। এই মাটির ঘরের মধ্যেই প্রজ্জ্বলিত হয়েছিল বঙ্গসংস্কৃতির শাশ্বত দীপশিখা। বাঙালির দেবায়তন ভাবনাতেও সেই চালাঘরের মার্জিত রূপই লক্ষ্য করা যায়। বাংলার নিজস্ব রীতির মন্দির বলতে ইঁটের তৈরি চালামন্দির। এই চালা আবার দোচালা চারচালা আটচালা কিম্বা প্রতীকী বারোচালায় বিন্যস্ত। চালা রীতির পাশাপাশি ইঁটের তৈরি টেরাকোটা ফলক সমৃদ্ধ রত্ন বা দেউলমন্দির উনিশ শতকে বাংলার প্রায় সর্বত্র লক্ষ্য করা গেছে। পাঁচ নয় এমনকি পঁচিশটি পর্যন্ত অলঙ্কৃত চূড়ার অনন্যসুন্দর দেউলমন্দির রয়েছে বাংলায়। বিশ শতকে এসেছে ইউরোপীয় স্থাপত্য প্রভাবিত দালানমন্দিরের জোয়ার। তবে সে মন্দিরে বিশেষ একটা অলংকরণ নেই বললেই চলে।

    গঙ্গাহৃদি বঙ্গভূমিতে পাথরের মন্দির বরাবরই দুর্লভ। বলাই বাহুল্য মন্দিরের প্রধান উপকরণ পাথর বয়ে নিয়ে আসা বড়ো সমস্যা। তার উপর বন্যা ঝড়ঝঞ্ঝা ভূকম্পনের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় কিম্বা বিধর্মীদের আঘাতে প্রত্যাঘাতে কত মন্দির গেছে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে। ক্ষেত্রসমীক্ষাসূত্রে বেশ কিছু পাথরের মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ দেখা গেছে। যেমন কেতুগ্রামের পাঁচুন্দি মিত্রটিকুরি ইত্যাদি। সিয়ান শিলালিপি থেকে জানা যায় পালবংশের রাজা নয়পাল পিতৃরাজ্য পুনরুদ্ধার করে বিভিন্ন দেবস্থানে মহার্ঘ বস্তু দান করেন। যেমন অট্টহাসের প্রস্তরমন্দিরে দান করেছিলেন সোনার কলস।

    পশ্চিম বর্ধমানে বিশেষ করে বরাকর বেগুনিয়াতে বরাকর নদের তীরে বেশ কয়েকটি পাথরের মন্দির তৈরি হয়েছিল পালযুগ বা তার আগে থেকে প্রাক চৈতন্যযুগের মধ্যে। আজও চারটে প্রস্তরমন্দির কালের ভ্রুকুটিকে উপেক্ষা করে টিকে রয়েছে। তিনটি মন্দির পূর্বমুখী আর একটি পশ্চিমমুখী। এগুলি রেখদেউল। দুটি মন্দিরের সম্মুখে রয়েছে বিশালাকার নন্দী বা বৃষ। প্রায় পঞ্চাশ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট। একটি মন্দিরের গর্ভগৃহে রয়েছে গণেশবিগ্রহ। মন্দির অভ্যন্তরে খোদিত শিলালেখ থেকে জানা যায় ১৪৬০ খ্রিষ্টাব্দে ফাল্গুন মাসে শুক্লাষ্টমী তিথিতে বুধবার রাজা হরিশ্চন্দ্রের প্রিয়তমা ভার্যা হরিপ্রিয়াদেবী শিবের উদ্দেশ্যে এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। আর একটি শিলালিপি থেকে জানা যায় নন্দ নামক জনৈক ব্রাহ্মণ ও তাঁর পত্নী ১৫৩৬ খ্রিষ্টাব্দে মন্দিরের সংস্কার কার্য করেছিলেন। তৃতীয় মন্দিরটি পশ্চিমমুখী। এখানে শিবলিঙ্গ রয়েছে। জেডি বেগলারের মতে চতুর্থ মন্দিরটি সর্বাধিক পুরাতন। প্রতিষ্ঠাকাল ষষ্ঠ বা সপ্তম শতক। প্রখ্যাত গবেষক পঞ্চানন মণ্ডল বরাকর বেগুনিয়ার এই মন্দিরগুলিকে জৈন শরাক মন্দির বলে দাবী করেছেন।কালো ধূসর বেলে পাথর দিয়ে তৈরি মন্দিরগুলি।

    পূর্ববর্ধমান জেলার পাথরের মন্দির বলতে জগদানন্দপুরের রাধাগোবিন্দ মন্দির। দোতালা চূড়াবিশিষ্ট ইঁট ও পাথরের অলঙ্কৃত ব্যতিক্রমী মিশ্ররীতির মন্দির। যার সৌন্দর্যের টানে আজও পর্যটকরা ভিড় করেন এই গ্রাম্যমন্দির প্রাঙ্গণে। কাটোয়া-কালনা ঝাঁ-চকচকে বাসরাস্তার ধারে জগদানন্দপুর বাসস্ট্যান্ড। দক্ষিণমুখো মিনিট চারেকের হাঁটা পথে পৌঁছানো যাবে প্রশস্ত মন্দির প্রাঙ্গণে। প্রায় ৮২ ফুট উঁচু আকাশ ছোঁয়া মন্দিরচূড়া। পঞ্চাশ শতক জমি জুড়ে ইট-পাথরের এই মিশ্ররীতির অলঙ্কৃত মন্দির। প্রবেশপথের তোরণের উপরে  ইস্টক নির্মিত হরগৌরী দেবালয়। এটিও দ্বিতল দালান রীতির মন্দির। মাথায় ইসলামিক স্থাপত্যের গম্বুজের শোভা। এই মন্দির তৈরি করেছিলেন প্রস্তরমন্দিরের রূপকার রাধামোহনেরপুত্র মধুসূদন ঘোষ চৌধুরী। পশ্চিমমুখী গর্ভগৃহে হরগৌরীর প্রস্তরমূর্তি। দেওয়ালে খোদিত পাথরের প্যানেলে দশাবতার চরিত্র। প্রবেশপথের পাশে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় ওঠা যায়। পূর্ব পশ্চিমে প্রসারিত লম্বা একটা বারান্দা মূল প্রস্তরমন্দিরের সঙ্গে যুক্ত।

    প্রস্তরমন্দিরের দোতলায় শীতকালে আগে পুজো হত। বিগ্রহ সেবার জন্য আটকোণা বেদির সম্মুখে কষ্টিপাথরের রাসমঞ্চটি আজও রয়েছে। এখানে আছে অষ্টসখীর প্যানেল। পাশ দিয়ে নেমে গেছে সিঁড়ি। এবার নীচে মূলমন্দিরের গর্ভগৃহ। কৃষ্ণলীলার বিচিত্র আলেখ্য খোদিত। দরজার মাথায় গজলক্ষ্মী মুর্তি। অলিন্দের প্যানেলে নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী। বিগ্রহ বলতে মহাপ্রভু এবং রাধাগোবিন্দ জিউ। সঙ্গে পূজিত হচ্ছেন কুলদেবতা দামোদর শিলা ও যশোর থেকে আনা লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ।

    নিচের নাটমন্দিরের স্তম্ভে খোদিত বিচিত্র প্যানেল। মুখ্য বিষয় - কৃষ্ণলীলা, চৈতন্যলীলা ও পুরাণের জনপ্রিয় কাহিনী যেমন ভগীরথের গঙ্গা আনয়ন, কৃষ্ণের জন্মলীলা, মহাপ্রভুর নীলাচলে রথযাত্রায় সপার্ষদ নৃত্য, রাম রাবণের যুদ্ধ, সিংহবাহিনী দুর্গা এবং জনপ্রিয় নরনারীর কুঞ্জর মূর্তি। রাধা একবার কৃষ্ণের সঙ্গে রসিকতা করার জন্য আটজন সখীসহ নিজে হাতির মতো সজ্জিত হয়েছিলেন। কৃষ্ণ ভ্রম করে হস্তীবধ করতে উদ্যত হলেন। সখীদের হাস্যকলরোলে কৃষ্ণের ভ্রম ভাঙে। এই দৃশ্যটি পরবর্তীকালে দারুণ জনপ্রিয় হয়েছিল ছাপা বইয়ে।

    মূলমন্দিরটির গঠনের দিক থেকে বেশ অভিনব, পঞ্চচূড়া বিশিষ্ট। রথাকৃতি এই মন্দির। মূলচূড়ায় খোদিত জগন্নাথের রথচিত্র ও চতুর্ভূজ নারায়ণ মূর্তি। কার্নিশে নানা মূর্তির অলংকরণ। সমগ্র মন্দির পরিকল্পনায় শৈব-শাক্ত-বৈষ্ণব ধর্মের মহা সমন্বয়ের বার্তাটি প্রকাশিত।
    মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন চৈতন্য পার্ষদ কুলাইগ্রামের পদকর্তা বাসু ঘোষের অধস্তন বংশধর রাধামোহন ঘোষ চৌধুরী। জ্যোতির্ময় ঘোষ চৌধুরীর লেখা 'মন্দিরের স্থাপনা বিবরণ' থেকে জানা যায় - রাধামোহনের পিতা কৃষ্ণদুলাল ঢাকায় নবাবের সামান্য কর্মচারী থেকে কর্ম দক্ষতার গুণে যশোরের রামনগরে তালুকদারি ও চৌধুরী খেতাব  পেয়েছিলেন। পরে নীলকুঠি কিনে রাতারাতি বিত্তবান হয়ে ওঠেন। একসময় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সুনজরে পড়ে যশোরের কালেকটর নিযুক্ত হন কৃষ্ণদুলাল। রামনগরে প্রাসাদোপম বাড়ি তৈরি করে প্রতিষ্ঠা করেন লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ। কিন্তু মৃত্যুর পূর্বে একমাত্র পুত্র রাধামোহনকে জন্মভূমি জগদানন্দপুরে এই লক্ষ্মীনারায়ণ জিউ'র মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা বলে যান।

    শতাধিক বৎসর পূর্বে রচিত নিবারণচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত কাটোয়ার ইতিহাসে (সম্পাদনাঃ ড.স্বপনকুমার ঠাকুর) জগদানন্দপুর শীর্ষক রচনাটি থেকে জানা যায় এই ব্যতিক্রমী মন্দিরটির ভিত খনন করেছিলেন স্বয়ং কৃষ্ণদুলাল ঘোষ ১২৪৬ সালের আষাঢ়মাসের শুক্লপক্ষ দশমী তিথি, সোমবারে। অতর্কিতে তিনি প্রয়াত হন। তাঁর অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করেন সুযোগ্য সন্তান রাধামোহন ঘোষ। শ্রীচট্টোপাধ্যায়ের মতে বহু লোকের পরিশ্রমের ফলে এগারো বৎসর ধরে ১২৫৭ সালে প্রস্তরমন্দিরের কাজ শেষ হয়। আরও দুবছর পরে নাটমন্দির ও শোভামন্দিরের কাজ সম্পন্ন হয়।

    অনেকেই বলেন বৃন্দাবনে লালাবাবুর মন্দির দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে রাধামোহন জগদানন্দপুরে এই মন্দির নির্মাণ করেন। উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে প্রয়োজনীয় পাথরগুলি ভাগীরথী নদী ও স্থানীয় সপুলা-মপুলানদির প্রবাহ পথে নিয়ে আসেন। উত্তরপ্রদেশ থেকে দক্ষ শিল্পীদের ও দাঁইহাটের খ্যাতিমান ভাস্করদের সহায়তায় সুদীর্ঘ সময় ধরে মন্দিরের কাজ নিস্পন্ন করেন প্রভূত অর্থ ব্যয় করে। দুর্ভাগ্যবশত শ্রীশ্রী রাধাগোবিন্দ জিউ প্রস্তরমন্দিরের দোতলার নাটমন্দির ১৩০৪ সালে ভূমিকম্পে ভেঙে পড়ে। সেই থেকে দোতলায় দেবসেবা বন্ধ হয়ে যায়।

    ঘোষবংশের বর্তমান প্রতিনিধি শিক্ষক শান্তব্রত ঘোষ জানিয়েছেন অন্য আরেক কাহিনী। স্বাধীনতা লাভের পরই যশোরের রামনগরের যাবতীয় সম্পত্তি পাকিস্থান সরকার বাজেয়াপ্ত করে নেয়। ফলে দেবসেবার ভাটা পড়তে থাকে। ১৯৩২-৩৩ সালে তদানীন্তন বর্ধমানের জেলা শাসক এল.এম. স্টুয়ার্ট সাহেব মন্দির পরিদর্শন করতে এসে মন্দিরের স্থাপত্যসৌন্দর্যে মুগ্ধ হন। এবং তৎকালীন ভারত সরকার যাতে মন্দিরের আর্থিক দায়ভার গ্রহণ করে তার জন্য চিঠি লেখেন। এদিকে ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারি প্রথা বিলোপের ফলে জগদানন্দপুরের জমিদারি হাতছাড়া হয়। ক্রমশ ঠাকুরসেবা মহাসংকটে পড়ে। পরবর্তী সময়ে ঠাকুরসেবার দায়িত্ব যেমন গৌড়ীয় বৈষ্ণবমঠের উপর অর্পিত হয় তেমনই স্থাপত্যকর্মের অনন্য নজির হিসাবে এই মন্দির অধিগ্রহণ করে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পুরাতত্ত্ব বিভাগ।

    রাধাগোবিন্দ জিউ মন্দিরের নিত্য সেবা ছাড়াও কৃষ্ণের জন্মাষ্টমী, রাধাষ্টমী,‌ঝুলনযাত্রা ও অন্নকূট উৎসব জাঁকজমকের সঙ্গে পালিত হয়। তবে দোল-হোলি উৎসবই মুখ্য। শুধু জগদানন্দপুর নয়; আশেপাশের একাধিক গ্রাম রাধাগোবিন্দের দোলযাত্রাকে কেন্দ্র করে মেতে ওঠে আনন্দে। দোলের আগের দিন সন্ধ্যে বেলায় বর্ণাঢ্য অধিবাস দিয়ে শুরু। দোলের দিন ও রাত অষ্টপ্রহর নাম সংকীর্তন। পরের দিন কীর্তন কবিগান যাত্রাভিনয় বাউলগান ইত্যাদি বিবিধ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। পঞ্চম দোলে গ্রাম প্রদক্ষিণ, ধূলোট এবং আবির খেলা। শেষে মচ্ছোব-প্রসাদ গ্রহণ। এই উপলক্ষে মন্দির প্রাঙ্গণে বসে জমজমাট মেলা। নাটমন্দির প্রাঙ্গণে পুতুল সজ্জার মধ্য দিয়ে রাধা কৃষ্ণের দোল যাত্রাকে প্রদর্শন করা হয় যা দেখার টানে অসংখ্য দর্শনার্থীর আজও সমাগম হয়।

    (কৃতজ্ঞতাঃ নবারুণ মল্লিক)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @