নকশাল ওয়ার্ডের কয়েদি

জেলে নগদ টাকা দেওয়া-নেওয়া চলে না। আপনার বাড়ির লোকেরা আপনার নামে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা জমা রাখতে পারেন। আপনি বিড়ি-সিগারেট, খবরের কাগজ, দৈনন্দিন টুকিটাকি জিনিস কিনতে পারেন। তা আপনার টাকা থেকে কর্তৃপক্ষ কেটে রাখবেন। সপ্তাহে একদিন ওয়ার্ডের দরজায় ‘বাজার’ বসে। যা কিনলেন, আপনার হিস্ট্রি টিকিটে তা লেখা হয়ে যায়। ডাক্তারবাবুকে ওই মেটরা সিগারেট দেন। মাছের ডায়েটে এত প্যাকেট, মাংসের ডায়েটে এত প্যাকেট, দুধের ডায়েটে এত প্যাকেট। কী সুন্দর বন্দোবস্ত!
(গত পর্বের পর)
আপনার সাথে বন্দোবস্ত ঠিক মতো হলে সে রাত থেকে মেটের পাশে আপনার থাকার ব্যবস্থা হয়ে যায়। ভালো চাদর-টাদর জুটে যায়। বিকেলে আমদানি ওয়ার্ড থেকে কয়েদিদের অন্য ওয়ার্ডে বদলি করা হয় এক এক করে। কিন্তু আপনি ‘গেস্ট’ কয়েদি হিসেবে ওই মেটের পাশে থেকে যান, যতদিন না বন্দোবস্ত মতো টাকা-পয়সা আপনার বাড়ি থেকে আসে। তারপর আপনি ডায়েট কার্ড পেয়ে গেলে অন্য ওয়ার্ডে বদলি হয়ে যান।
স্বাভাবিকভাবে আমদানি ওয়ার্ডে বন্দিদের থেকে পাওয়া টাকা হেড জমাদার, জমাদার, মেট ইত্যাদির মধ্যে ভাগ হয়ে যায়। আমদানি ওয়ার্ডে ডিউটি পাওয়ার জন্য হেড জমাদারদের টাকা-পয়সা গুঁজে দিতে হয় ওয়ার্ড সেপাই ও ওয়ার্ড মেটদের।
আরও পড়ুন: জেলের ভিতরে জানতে পারলাম এক সাংঘাতিক ব্যাপার
এছাড়া, জেল সেপাইরা কয়েদিদের প্রাপ্য চাল-ডাল-তেলের ভাগ পান। জেলের সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের যে খদ্দরের গামছা দেওয়া হয়, তা দিয়ে জেল সেপাইদের প্যান্টের পকেট
তৈরি হয়। তার মধ্যে করে অনেক কিছুই বেরিয়ে যায় কয়েদিদের বঞ্চিত করে।
পরের দিন আমি ও হরিপদ অন্য ওয়ার্ডে বদলি হয়ে গেলাম। আমাদের হিস্ট্রি টিকিটের এক কোনায় লাল কালিতে ‘N’ লেখা। অর্থাৎ নকশাল। আমাদের পাঠানো হল নকশাল ওয়ার্ডে। ওয়ার্ড নাম্বার যতদূর মনে আছে ‘তেরো’।
যেই ওয়ার্ডে এলাম, তার তিনটি ভাগ। প্রত্যেকটি গ্রিল দিয়ে ভাগ করা। মাঝে একটা দরজার মতো ফাঁক। প্রথম ভাগটি সম্পূর্ণভাবে ‘নকশাল’ বন্দিদের দ্বারা পূর্ণ এবং তারা প্রত্যেকেই চারু মজুমদার গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। এখানে দু’জন আমার চেনা বন্ধু বেরিয়ে গেল। একজন সাগর চট্টোপাধ্যায়। আমাদের ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় ওর আসা-যাওয়া ছিল। কবিতা লিখত। ‘পূর্বদেশ’-এ ওর কবিতা ছাপা হয়েছিল। আরেকজনের নাম প্রলয়েশ মিত্র। সাগরের আত্মীয় – সম্পর্কে ভায়রাভাই – দু’জন দু’বোনকে বিয়ে করেছিল। ওই ওয়ার্ডের সমস্ত রাজনৈতিক বন্দিদের অঘোষিত নেতা ছিল সাগর। আরেকজনও ছিল। বেলঘরিয়ায় বাড়ি। একটু কট্টরপন্থী। নাম ভোম্বল। ওই বন্ধুরা কমিউনের মতো করে একসঙ্গে থাকত, বাইরের লোক দেখাসাক্ষাৎ করতে এলে যা কিছু দিত, সব একসাথে জড়ো করে সব্বাইয়ের মধ্যে ভাগবণ্টন করে দেওয়া হত। বিশেষত বিড়ি। বিড়ির এমনই নেশা ছিল যে, এক রাতে এদের মধ্যে এক বন্ধুকে, সবাই যখন ঘুমুচ্ছে, তখন হামাগুড়ি দিয়ে গিয়ে অন্যের ব্যাগ থেকে বিড়ি চুরি করতেও দেখেছি। যা হোক, ওদের রাজনৈতিক ক্লাস হত। সকালে সবাই একসঙ্গে দাঁড়িয়ে ইন্টারন্যাশানাল গাইত।
আমি ও হরিপদ রাজনৈতিক কারণেই ওদের অন্তর্ভুক্ত হইনি। তবে ওদের পাশাপাশিই গ্রিলের ওপারে, আমরা দু’জন ছিলাম। ওই ওয়ার্ডে এছাড়াও ছিল বহু সাধারণ বিচারাধীন বন্দি। এদের মধ্যে পাঁচ-ছয় জনের সঙ্গে কিছুদিনের মধ্যেই আমার রাজনৈতিক সম্পর্ক তৈরি হয়ে গেল। একজন ছিলেন বয়স্ক মানুষ। বাসন্তীতে বাড়ি। এমসিসির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। আমরাও একটা ‘কমিউন’ বানিয়ে নিয়েছিলাম। একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া, রাজনৈতিক আলোচনা। সাগরেরা যখন ইন্টারন্যাশানাল গাইত, গ্রিলের এপাশে আমরাও দাঁড়িয়ে উঠে একসঙ্গে গলা মেলাতাম।
আরও পড়ুন: আলিপুর জেলে প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা
ওদের মধ্যে কয়েকজন তরুণ আমাদের সিপিআই (এমএল)-এর সঙ্গে না থাকাটা মানতে পারছিল না। আমরা কেন চারু মজুমদারকে মানি না, স্বয়ং মাও যাকে সমর্থন করেছেন, আমরা, বিশেষ করে আমি কেন তাঁর বিরোধী, আমাকে তার জবাবদিহি করতে হত। আমার খাতাপত্র তো একদিন নিয়ে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে বাইরে ফেলে দিয়েছিল একজন। মেটের সঙ্গে বন্দোবস্ত করে আমাদের গ্রুপকে আলাদা করে দিয়েছিল বেশ কয়েকবার। এসব কাজে ভোম্বলের সাপোর্ট থাকলেও সাগর তা পছন্দ করত না। ওদের মধ্যে অনেকে সাগর ও প্রলয়েশকে মধ্যপন্থী বিবেচনা করত।
(চলবে…)