জেলের ভিতরে জানতে পারলাম এক সাংঘাতিক ব্যাপার

সকাল ছ’টার সময় ওয়ার্ডের প্রথম গ্রিলের দরজা খুলে দেয় পাহারায় থাকা জেল সেপাই। বন্দি আসামিদের হাঁটু মুড়ে বসে থাকতে হয়। একজন জমাদার সেপাই এক, দো, তিন করে আমাদের গুনতি করেন। জেল সেপাইয়ের কাছে নোট থাকে, গতকাল রাত্রে ডিউটিতে যোগদানের সময় কতজন বন্দিকে তিনি গুনে নিয়েছিলেন, তার হিসেব মিলিয়ে নেন। এইভাবে সব ওয়ার্ডের গুনতি শেষ না হওয়া পর্যন্ত আসামিদের একইভাবে বসে থাকতে হয়। গুনে যদি গত রাতে যত বন্দি ছিল, তার সঙ্গে আজ সকালে গুনতি করা বন্দির সংখ্যা এক হয়, তাহলে ঘণ্টা বাজে। আমরা উঠে দাঁড়াতে পারি। সকাল ৯টা পর্যন্ত আমরা ওয়ার্ডের বাইরে থাকতে পারি।
(গত পর্বের পর)
ন’টার মধ্যে বন্দিদের স্নান ও টিফিন সেরে নিতে হয়। আমাদের দিয়ে জল তোলা ও ঘাস তোলার কাজ মেটরা করিয়ে নেয় ওই সময়ে। অন্য কোনো বন্দিকে এই কাজ কখনো কিন্তু করতে হয় না। যারা নতুন ‘আমদানি’ হয়, তাদের মধ্য থেকে মেট বেছে বেছে বন্দিদের ওই কাজ করতে বাধ্য করে।
দুপুরে খাওয়া-দাওয়া। এক ডাব্বা ভাত, এক ডাব্বা তরকারি, এক গ্লাস ডাল। শেষে আবার গুনতি। সকালে যেই জেল সেপাই ছিলেন, তিনি ‘গিনতি’ করে বদলিতে যে সেপাই এলেন, তাকে ‘আসামি’দের সংখ্যা মিলিয়ে বুঝিয়ে দিলেন। তিনি বুঝে নিলেন নিজে একবার ‘গিনতি’ করে। তারপর ওয়ার্ডে তালা লাগিয়ে তিনি ওয়ার্ডের বাইরে ‘পাহারা ঘুম’ দিলেন বসে বসে।
আরও পড়ুন: আলিপুর জেলে প্রথম রাতের অভিজ্ঞতা
খাওয়া-দাওয়া শেষে বন্দিরা প্রায় সকলেই চাদর বিছিয়ে ঘুম দিলেন। ওয়ার্ডের মেটের বসে থাকা ও শোয়ার জায়গা ওয়ার্ডের ঠিক মাঝখানটায়। তার সব কিছুই স্পেশাল। ধোলাই করা চাদর পাতা ধবধবে বিছানা। খাতাপত্র। তিনি একবার নতুন আসা কয়েদিদের চোখ বুলিয়ে নিয়ে তাদের আর্থিক অবস্থা মালুম করে নিলেন। পছন্দ মতো কয়েদিদের ডেকে তাদের সঙ্গে কিছুক্ষণ আলাপ-সালাপ চলল। একসময় আমাকেও ডাকলেন তিনি। আমি গিয়ে বসলাম তাঁর সামনে। নানা গল্প-গাছালি চলল। ‘বাড়ি কোথায়’, ‘বাড়িতে কে কে আছেন’, ‘কী করতেন আপনি’ ইত্যাদি। তারপরেই জিজ্ঞাসা, দুপুরের খাওয়া-দাওয়া কেমন লাগল। আমি বললাম, জেলের খাওয়া-দাওয়া যেরকম হয়, সে রকমই। আমি মাছ, মাংস, দুধ ইত্যাদি খেতে চাই কিনা দরদের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলেন। অতঃপর যা জানতে পারলাম, সে এক সাংঘাতিক ব্যাপার! “জেলখানায় আপনি যদি টাকা দিতে পারেন, সব কিছু পেতে পারেন, মায় গাঁজা-চরস পর্যন্ত। আপনি তো কপর্দকহীন কয়েদি, টাকা দেবেন কোত্থেকে? আরে মশাই, সব উপায় আছে। আপনি টাকা চেয়ে বাড়ির লোকের কাছে একটা চিঠি লিখে দিন। আমাদের লোক গিয়ে টাকা নিয়ে আসবে।”
রেটও বলে দিলেন, কী ডায়েট পেতে কত লাগবে। শুধু দুধ পেতে কত, মাছ-মাংস পেতে কত, ইত্যাদি। এবং কোন ডায়েটের জন্য কত টাকা দিতে হবে। জেল হাসপাতালের ডাক্তার কয়েদিদের কার কী রোগ আছে তা নির্ধারণ করে দুধ-এর ডায়েট কার্ড, মাছ-মাংসের ডায়েট কার্ড ইস্যু করেন। যারা রোগী নন, অথচ বনেদি কয়েদি, তারা টাকা জোগাতে পারলে ‘রোগী’ হয়ে যান ডাক্তারের বিচারে। তিনি সেই মতো ডায়েট কার্ড ইস্যু করেন।
জেলে নগদ টাকা দেওয়া-নেওয়া চলে না। আপনার বাড়ির লোকেরা আপনার নামে জেল কর্তৃপক্ষের কাছে টাকা জমা রাখতে পারেন। আপনি বিড়ি-সিগারেট, খবরের কাগজ, দৈনন্দিন টুকিটাকি জিনিস কিনতে পারেন। তা আপনার টাকা থেকে কর্তৃপক্ষ কেটে রাখবেন। সপ্তাহে একদিন ওয়ার্ডের দরজায় ‘বাজার’ বসে। যা কিনলেন, আপনার হিস্ট্রি টিকিটে তা লেখা হয়ে যায়। ডাক্তারবাবুকে ওই মেটরা সিগারেট দেন। মাছের ডায়েটে এত প্যাকেট, মাংসের ডায়েটে এত প্যাকেট, দুধের ডায়েটে এত প্যাকেট। কী সুন্দর বন্দোবস্ত!
(চলবে…)