শতবর্ষের দোরগোড়ায় শরবতের প্যারামাউন্ট


শরবত আর বোমার মধ্যে কী সম্পর্ক? বা, শরবত এবং স্বাধীনতা? স্বাধীনতা আন্দোলনে বাংলার অগ্নিযুগ নিয়ে কোনও কুইজ হলে সেখানে থাকতেই পারে এমন প্রশ্ন। কারণ, শরবত, বোমা এবং বন্দুকের মধ্যে একটা যোগাযোগ ছিল। আর সেই ইতিহাস শুনতে হলে আমাদের যেতে হবে কলেজ স্ট্রিটের প্যারামাউন্ট শরবতের দোকানে।
১৯১৮ সালে বরিশালের নীহাররঞ্জন মজুমদার কলকাতা এসে এই প্রতিষ্ঠানের সূচনা করেন, তখন এর নাম ছিল প্যারাডাইস। কিন্তু শরবত বিক্রি তাঁর প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল না। শরবতকে সামনে রেখে দোকানের পিছনে চলত স্বদেশী কাজ কর্ম। এটি ছিল বিপ্লবী সতীন সেন-এর স্বদেশী অনুশীলন কেন্দ্র। এখানে আসতেন বাঘাযতীনের মত বিপ্লবীরা।

প্যারামাউন্ট-এর ইতিহাস সুদীর্ঘ। শতবর্ষের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে প্যারামাউন্ট। বছর ফুরালেই পা রাখবে ১০০-তে। এই নিয়েই কথা হচ্ছিল প্যারামাউন্টের দ্বিতীয় প্রজন্মের কর্ণধার নীহাররঞ্জন মজুমদারের ছেলে মৃগেন্দ্র মজুমদারের সঙ্গে। কথা বলতে বলতে উঠে এল প্যারামাউন্টের অনেক অজানা তথ্য। এখানে আসতেন বাঘাযতীনের মত বিপ্লবীরা। এসেছেন নেতাজি সুভাষ চন্দ্র বসুও। এক গ্লাস শরবতের আড়ালে গুপ্ত সমিতির কাজ। কিন্তু ব্রিটিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে এই গোপন স্বদেশীয়ানা একদিন ধরা পড়ে গেল। পুলিশ এসে বন্ধ করে দিল শরবতের দোকান। কেটে গেল অনেকগুলো বছর। ফের ১৯৩৭ খুলল দোকান খুলল। এবার ‘প্যারাডাইস’এর নাম বদলে রাখা হল প্যারামাউন্ট।
শুধু বিপ্লবীদের কথা নয়, মৃগেন্দ্রবাবু শোনালেন এই শরবতের দোকানের সঙ্গে বিদ্রোহী কবির প্রাণের যোগাযোগের কথা। ‘বল বীর, বল উন্নত মম শির’-এর কবি এখানে নিয়মিত আসতেন শরবতের টানে। সময় পেলেই ছুটে যেতেন প্যারামাউন্টে শরবতের গ্লাসে চুমুক দিতে। সত্যজিৎ রায়ও এখানে এসেছেন।
বাঘাযতীন, নজরুল তো হল, কিন্তু প্যারামাউন্টের শরবতের সমঝদারের তালিকাটা ওখানেই শেষ নয়। আরও আছে চমকে যাওয়ার মতো নাম। এখানে আসতেন উত্তমকুমার। আসতেন সুচিত্রা সেন।
এইসব বিশিষ্টরা কীসের টানে আসতেন? মানে কোন ব্র্যান্ডের সরবত ছিল তাঁদের কাছে এক নম্বর? মৃগেন্দ্রবাবু বললেন, “বাবা বলতেন, এঁদের বেশির ভাগেরই প্রিয় শরবত বলতে ছিল ডাবের শরবত। এক গ্লাস বা কখনো দুই-তিন গ্লাস চুমুক দিয়ে অনেকেই বলে উঠতেন আহ!। এই শরবতের রেসিপি যাঁর দেওয়া, সেই নাম শুনলে চোখ কপালে উঠবে। তাঁর নাম আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়।”
শরবতের যে কত বৈচিত্র্য হতে পারে তা প্যারামাউন্টে না ঢুকলে জানা যাবে না। দা দিয়ে ডাব কেটে জল খেয়ে নেওয়া - এ তো চিরকালীন অভ্যাস। সেই ডাবের জল দিয়ে শরবত কীভাবে তৈরি হয় তার একটা গল্প বললেন মৃগেন্দ্র মজুমদার। গল্পটা এইরকম - ‘প্যারামাউন্ট মানে ডাবের শরবত। সবার জানা। এই ডাব আনা হত বসিরহাট থেকে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় নীহাররঞ্জন মজুমদারকে বলেছিলেন কীভাবে ডাবের শাঁস মিশিয়ে শরবতে আনতে হবে নতুন স্বাদ। সেই ভারতীয় বিজ্ঞানীর রেসিপিতেই প্রায় একশো বছর ধরে টানা ব্যাট করে যাচ্ছে প্যারামাউন্টের ডাবের শরবত।

শুধু ডাবের শরবত নয়, প্যারামাউন্টের অন্য বিখ্যাত ব্র্যান্ডের নাম হল, গ্রেপস ক্রাস, মাঙ্গম্যানিয়া প্রমুখ। কোনও কৃত্রিম রং মেশানো হয় না প্যারামাউন্টের শরবতে।
এটাও বলতে হবে, প্যারামাউন্ট কখনও বিজ্ঞাপন করে না। মানুষের আস্থা আর মুখের কথাই তাদের বিজ্ঞাপন।