আ হোলি কন্সপিরেসি : ধর্ম বনাম বিজ্ঞানের লড়াইয়ে মুখোমুখি সৌমিত্র-নাসিরুদ্দিন

মৌলবাদ (Fundamentalism) কমবেশি সবেতেই। যেমন সংখ্যাগুরুতে, তেমন সংখ্যালঘুতে। এই মুহূর্তে ভারতবর্ষে সবচেয়ে চর্চিত বিষয় ধর্ম (Religion) বনাম বিজ্ঞান (Science)। এই বিষয়টি অত্যন্ত সুনিপুণভাবে উঠে এল শৈবাল মিত্রের ‘আ হোলি কন্সপিরেসি’ (A Holy Conspiracy) ছবিতে। রাজনীতির ঊর্দ্ধে গিয়ে মানুষ। অতএব মানুষের জয় হোক। মৌলবাদ চিরকাল বিজ্ঞানকে, শিক্ষাকে দূর করে রেখেছে। ডারউইনের তত্ত্ব মানতে সে নারাজ। তাই পলাশডাঙার এক চার্চ নিয়ন্ত্রিত বিদ্যালয়ে জীবন বিজ্ঞানের ক্লাসে ডারউইন পড়ানোর আগে বাইবেলের ‘জেনেসিস’ অধ্যায় পড়ানোর রীতি। ঘটনাচক্রে বিজ্ঞানের শিক্ষক আবার একজন আদিবাসী। কুণাল বাস্কে। তিনি মনে করেন বিদ্যালয়ের এই ভাবনা অত্যন্ত প্রাচীন, গোঁড়া সর্বোপরি বিজ্ঞানের পরিপন্থী। তাই রাষ্ট্রের চোখে তিনি ‘ক্রিমিনাল’। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। শিক্ষক কুণাল বাস্কেকে গ্রেপ্তার করে আদালতে তোলা হয়। আদালতে দুই আইনজীবী। বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায় এবং অ্যান্থনি ডিসুজা। অত্যন্ত সুচারুভাবে পরিচালক দেখান গোটা সমাজব্যবস্থা কীভাবে ফ্যাসিবাদে নিমজ্জিত হয়। এ ভাবনা তিনি পেয়েছেন আমেরিকান নাটক ‘ইনহেরিট দ্য উইন্ড’ (Inherit the Wind) থেকে। উল্লেখ্য, এই নাটক নিয়ে এর আগে চন্দন সেনের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হয়েছে ‘অপবিত্র’। কিন্তু শৈবাল মিত্র এ নাটকের শুধুমাত্র বঙ্গীকরণ করতে চাননি। সাম্প্রতিক সময়কে তুলে এনেছেন নানা ঘটনা পরম্পরায়, ঘাত প্রতিঘাতে৷ ‘আ হোলি কন্সপিরেসি’ তাই প্রতিবাদের কথা বলে, বিজ্ঞানের কথা বলে।
বসন্তকুমার এবং অ্যান্থনি — দুই আইনজীবী সমাজের দুই মেরুর অবস্থানে রয়েছেন। একজন লড়েন ধর্মের পক্ষ নিয়ে, আরেকজন লড়েন বিজ্ঞানের পক্ষ নিয়ে। এই দুই শক্তিশালী চরিত্রে অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় (Soumitra Chatterjee) এবং নাসিরুদ্দিন শাহ (Nasiruddin Shah)। ভারতবর্ষের দুই তাবড় অভিনেতা একসঙ্গে। এই প্রথম, এই শেষ। শৈবাল মিত্র (Saibal Mitra) পরিচালিত ‘আ হোলি কন্সপিরেসি’ (A Holy Conspiracy) ছবির সাক্ষী থাকল বাংলা। যদিও এর আগে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের (KIFF 2022) দ্বিতীয় দিনে দেখানো হয়েছিল দুই দাপুটে অভিনেতার এই ছবি।
দেশের পরিস্থিতি, টানাপড়েন, সামাজিক অবস্থার সংকট ইত্যাদি নিয়ে পরিচালক শৈবাল মিত্র অনেকদিন ধরেই চিন্তা-ভাবনা করছিলেন বলে জানান। সেখান থেকেই জেরোম লরেন্স এবং রবার্ট ইলির লেখা এই নাটকটি সিনেপর্দায় নির্মাণ করবেন বলে পরিকল্পনা করেন। গতবছর দেশের ধর্ম-সংকট নিয়ে সোচ্চার হয়েছিলেন নাসিরুদ্দিন শাহ স্বয়ং। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় নিজেও আজীবন সর্বধর্ম-সমন্বয়ে বিশ্বাস করে এসেছেন। ‘আ হোলি কন্সপিরেসি’-ও তেমনই এক গল্পের প্রেক্ষাপটে সাজানো।
ছবিতে রয়েছে চারটি ভাষার ব্যবহার- বাংলা, ইংরেজি, হিন্দি ও সাঁওতালি। চার ভাষাই স্পষ্ট, জোরালো। ছোট্ট একটি শহরতলিকে ঘিরে গল্পের প্লট বোনা হয়েছে। যেখানে মূলত আদিবাসীরাই বাস করেন এবং ঘটনাচক্রে প্রত্যেকেই ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। এখানকারই এক বিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক কুণাল জোসেফ বাস্কে। যিনি নিজেও ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান। বলা হয় তিনি বাইবেল বিরোধী কাজ করেছেন। এই নিয়ে শুরু হয় ধর্ম-রাজনীতির টানাপোড়েন। চারপাশে যেমনটা হয় আরকি!
সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণের পর পরিচালক শৈবাল মিত্র স্মৃতিচারণ করেছিলেন বঙ্গদর্শনে। লিখেছিলেন, “যেদিন ওঁর বাড়ি গিয়ে প্রস্তাবটা দিই মনে হল উনি ঠিক বিশ্বাস করলেন না। কিন্তু ক্রমশ ছবিটির চিত্রনাট্য পড়ে নাসির সাহেবের সঙ্গে কথা বলে খুবই উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু সেই ছবিতেও দুই বিরাট মাপের অভিনেতার একসঙ্গে ডেট পাওয়া নিয়ে অনেক বিনিদ্র রাত আমাকে কাটাতে হয়েছিল। এর মধ্যে সৌমিত্রদার শরীর ক্রমশ খারাপ হচ্ছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম না শেষ পর্যন্ত সৌমিত্রদা শুটিং করে উঠতে পারবেন কিনা। ” (মূল লেখাঃ “সৌমিত্রদাকে আমরা দেখলাম, শরীরের যাবতীয় অসুস্থতাকে ভুলে গিয়ে অভিনয় করে চলেছেন”)
বাংলা চলচ্চিত্রের জন্য এ এক প্রাপ্তি। পর্দায় আরও একবার সৌমিত্রবাবুকে দেখার সুযোগ হল। ভাবতে ভালো লাগছে, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় আজীবন যা বিশ্বাস করে এসেছেন, তাঁর শেষ দিকের ছবিতেও সেই বিশ্বাস উজার করে দিয়েছেন। এই শিরদাঁড়া আজ বিরল।
প্রগতিশীল শিক্ষকের সঙ্গে ধর্ম ও রাজনীতির টানাপড়েন কীভাবে সম্ভব? স্বাধীন চিন্তার সঙ্গে মৌলবাদী চিন্তার দ্বন্দ্ব, এ-ও সম্ভব? মানুষের জনক ঈশ্বর না বিবর্তনবাদ? এমন নানাবিধ প্রশ্ন ও পাল্টা প্রশ্ন ঘিরে এগিয়েছে ছবির গল্প। এসেছে উত্তর, প্রত্যুত্তর।
শিক্ষক কুণাল বাস্কের চরিত্রে চোখে লাগার মতো অভিনয় করেছেন শ্রমণ চট্টোপাধ্যায় (Sraman Chatterjee)। কোমল অভিনয়ে নজর কেড়েছেন অমৃতা চট্টোপাধ্যায়। অন্যান্য চরিত্রে যথাযথ অভিনয় করেছেন অনসূয়া মজুমদার, পার্থপ্রতিম মজুমদার, জগন্নাথ গুহ, কৌশিক সেন, বিপ্লব দাশগুপ্ত। অসামান্য সংগীত পরিচালনা করেছেন পণ্ডিত তেজেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার।
তবে এ ছবি সৌমিত্র-নাসিরুদ্দিনের। দুজনেই বলে চলেছেন তীক্ষ্ণ গভীর সংলাপ। বুনেছেন জট। নিজেরাই তা ছাড়িয়েছেন। সংলাপকে হাতিয়ার করেছেন, বিশ্বাস করেছেন। নাহলে এ মাপের অভিনয় বড়ো দুর্লভ। কেই উচ্চকিত নন, অথচ দ্রিমিদ্রিমি উত্তেজনার পারদ তুলেছেন প্রতি দৃশ্যে।
‘আ হোলি কন্সপিরেসি’ সময়ের ফসল। যে শিল্পে সাম্প্রতিক সময় ধরা থাকে অতি যত্নে, তা প্রতি যুগে প্রাসঙ্গিক থেকে যায়। শৈবাল মিত্র তেমনই একটি কাজ করেছেন। এমন তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ বাংলা চলচ্চিত্রে দুর্লভ।