হিন্দু-মুসলমানের সম্মিলন ঘটেছে বাংলার সরা শিল্পে

সরার উৎপত্তি হয়েছিল সাধারণত হাঁড়ি ঢাকা দেওয়ার জন্য। পরে নানান ধর্মীয় উৎসবে সরার ব্যবহার হতে থাকে। আবার বাংলার লোকশিল্পীরা ওই সরার গায়েই অনবদ্য সব ছবি এঁকে এক নতুন শিল্পধারার জন্ম দিলেন। সরা শিল্প তাই বাংলার নিজস্ব সম্পদ। প্রাচীন কাল থেকেই সরাচিত্রের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বাঙালি। মাটির তৈরি সরার উত্তল দিকে ছবি আঁকা হয়। ভরিয়ে দেওয়া হয় উজ্জ্বল রং-এ। সবার শেষে তার ওপর দেওয়া হয় সাবুর আঠা কিংবা তেঁতুল বীজের গাদের প্রলেপ। এতে সরা আরও চকচকে হয়। সরার মধ্যে অঙ্কনের কাজ মূলত কুমোরেরাই করে থাকেন। ধর্মীয় কাজকর্মের পাশাপাশি আজকাল শহুরে বাঙালি রংবেরং-এর সরা দিয়ে ঘর সাজান।
আকার এবং ব্যবহারের ওপর ভিত্তি করে সরাকে অনেক রকম প্রকারে ভাগ করা যায়। যেমন – ফুলসরা, ঢাকনাসরা, মুপিসরা, ধূপসরা, আমসরা, এয়োসরা, তেলনিসরা, গাজির সরা, মহরম সরা, লক্ষ্মীসরা, আঁতুরসরা ইত্যাদি ইত্যাদি। সব রকম সরাতে ছবি আঁকা থাকে না। ছবিওয়ালা সরাগুলির মধ্যে লক্ষ্মীসরার প্রচলন সবথেকে বেশি। কৃষিপ্রধান বাংলায় ফসলকে সমৃদ্ধির প্রধান উৎস মনে করা হয় পুরোনো যুগ থেকেই। আশ্বিন মাসের শেষ দিকে ধান পাকা শুরু হয়, আশ্বিনের পূর্ণিমায় সম্পদের দেবী লক্ষ্মীর উপাসনা করেন গৃহস্থরা। এই কোজাগরি লক্ষ্মীপুজোয় পশ্চিমবঙ্গের হিন্দুরা সাধারণত মাটির প্রতিমায় পুজো করেন, আর পূর্ববঙ্গের হিন্দু গৃহস্থরা পুজো করেন মাটির সরায়। তবে দেশভাগ, বিশ্বায়ন প্রভৃতির জন্য এখন মানুষ ছড়িয়ে ছিটিয়ে গেছেন, তাই পুজোর রীতিও ছড়িয়ে পড়েছে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায়।
লক্ষ্মীসরার গায়ে আঁকা থাকে লক্ষ্মী, নারায়ণ, লক্ষ্মী পেঁচা, কড়ি, ধানের শিষের ছবি। বাংলা জুড়ে লক্ষ্মীসরার অলংকরণে বৈচিত্র্য দেখা যায়। যেমন – সুরেশ্বরী সরা, একলক্ষ্মী সরা, তিনপুতুল সরা, পাঁচপুতুল সরা, জয়া-বিজয়া সরা।
হিন্দু ধর্মের অন্যান্য দেবদেবীদের কেন্দ্র করেও সরা আঁকা হয়। কোনো সরায় দুর্গাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়, কোথাও দুর্গার পাশে বিরাজ করেন মহাদেব। কোথাও থাকেন রাধাকৃষ্ণ। বৈষ্ণব, শাক্ত কিংবা শৈবরা পছন্দ অনুযায়ী সরার গায়ে দেবদেবীর ছবি আঁকিয়ে নেন। মুসলমান সমাজেও সরার ব্যবহার দেখা যায়। টাঙ্গাইলে বানানো গাজির সরা এবং মহরমের ছবি আঁকা মহরমের সরা মুসলমানরা যত্ন করে রাখেন। লতা-পাতার নকশা আঁকা সরাও মুসলমানরা ঘর সাজাতে ব্যবহার করেন। এইভাবে বাংলার সরাশিল্পে হিন্দু-মুসলমানের দারুণ সম্মিলন ঘটেছে।
তথ্যঋণ – বিজনকুমার মণ্ডল, নিসার হোসেন, দীপঙ্কর পাড়ুই।
ছবিসূত্র – ফেসবুক