No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    “গানের কোনো মানচিত্র হয় না” – ‘সোনার বাংলা সার্কাস’-এর প্রবর রিপন এক্সক্লুসিভ

    “গানের কোনো মানচিত্র হয় না” – ‘সোনার বাংলা সার্কাস’-এর প্রবর রিপন এক্সক্লুসিভ

    Story image

    পাঁচ সদস্য নিয়ে ২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশের ‘সোনার বাংলা সার্কাস’ ব্যান্ড। খুব কম সময়ের মধ্যে প্রবল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছেন দুই বাংলাতেই। এই প্রথম কলকাতায় এসেছিলেন তাঁরা। শুরু হয়েছিল প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ে মহীনের ঘোড়াগুলির সদস্য তাপস বাপি দাসের চিকিৎসার জন্য ফান্ডরেইজিং কনসার্ট দিয়ে। তারপর একে একে আরও অনুষ্ঠান করেছেন কলকাতায়। ‘সোনার বাংলা সার্কাস’-এর মুখ্য সংগীতশিল্পী-গীতিকার প্রবর রিপন-এর সঙ্গে কিছুক্ষণ তুখোড় আড্ডা হল বঙ্গদর্শন.কম-এর প্রতিনিধি সুমন সাধু’র। প্রকাশিত হল এই মুহূর্তে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় রকশিল্পী প্রবর রিপনের সাক্ষাৎকার। রিপন একইসঙ্গে সংগীতশিল্পী, গীতিকার এবং কবি। তাঁর লেখা কয়েকটি বই ইতিমধ্যেই পাঠকমহলে সমাদৃত।

    _____

    কলকাতায় আপনাকে স্বাগত৷ এই প্রথম কলকাতায় এলেন। পরপর কনসার্ট করছেন। কলকাতার শ্রোতাদের এই উচ্ছ্বাস দেখে কী বলতে ইচ্ছা করছে?

    ‘সোনার বাংলা সার্কাস’ ব্যান্ড নিয়ে এই প্রথমবার কলকাতায় এলাম। শ্রোতাদের চমৎকার উচ্ছ্বাস। এত ভালোবাসা আর সম্মান পেয়ে আমরা সত্যিই মুগ্ধ।

    বাংলাদেশের একটি সংবাদ মাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, মানুষ নিজেদের আর পৃথিবীর ধ্বংসলীলায় মেতেছে। বিস্তারিত বলবেন?

    আমাদের অ্যালবাম ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’-এর মূল থিম ছিল এটা। অ্যালবামটা শুরু হচ্ছে হায়েনা এক্সপ্রেসে চড়ে। জন্ম থেকে কীভাবে একজন মানুষ মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যায় এবং এই যাত্রাকালে মানুষ নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারে – এই গল্পগুলোই আসলে তুলে ধরতে চেয়েছি। বারবার মনে হয়েছে, মানুষ নিজেদের আর পৃথিবীর ধ্বংসলীলায় মেতেছে। কেবল অধঃপতন আর নিঃশেষের খেলায় মেতেছে। হায়েনার মতো এগিয়ে চলা মানবসভ্যতার নানা দিক নিয়ে বাঁধা ৯টি গান নিয়ে এই অ্যালবাম: ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’, ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’, ‘অন্ধ দেয়াল’, ‘সূর্যের অন্ধকার’, ‘আমার নাম অসুখ’, ‘ক্রমশ’, ‘পারফিউমের ফেলে দেওয়া বোতল’, ‘আত্মহত্যার গান’, এবং ‘এপিটাফ’।

    সব সংগীতই লোকসংগীত। কারণ সব গানই লোকে গাইছে। আমি যেহেতু পূর্ববঙ্গের মানুষ, বাউলাঙ্গের গানই তো আমাদের শিকড়। আমরা নতুন অ্যালবামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেখানে অনেক লোকায়ত জিনিস থাকবে।

    টিম সোনার বাংলা সার্কাস

    অ্যালবামের নাম ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ কেন?

    মানুষ প্রজাতি। বনের হায়েনার সঙ্গে এর কোনো যোগ নেই। বনের হায়েনা শুধু হায়েনা, মানুষ শুধু মানুষ। ‘হায়েনা এক্সপ্রেস’ হল হায়েনা মানুষের গল্প। হায়েনার একটা স্বভাব আছে না, দলবদ্ধভাবে কোনো কিছুকে আক্রমণ করে খুবই বীভৎসভাবে খেয়ে ফেলে! তো মানুষ পৃথিবীকে এরকম ভাবে খেতে বসেছে। পুরো পৃথিবীর সমস্ত মানুষগুলো এখন, অতি লোভে অতি ভোগে পৃথিবীকে ধ্বংস করতে বসেছে। যার ফলশ্রুতি গ্লোবাল ওয়ার্মিং, সমুদ্রের বরফ গলছে, নানা কৃত্রিম দুর্যোগ। এবং সেটা কীসের উপরে! গতি বা চাকা। সেটাই হায়েনা এক্সপ্রেস।

    ‘পৃথিবীর ধ্বংসলীলা’ আমরা কোভিডকালে কমবেশি দেখেছি, যা আমাদের জীবন আমূল পাল্টে দিয়েছে। তাহলে কি কোভিডের পর মানুষ কোনো শিক্ষাই গ্রহণ করল না?

    আমার মনে হয় মানুষ অবহিত হলেও পৃথিবী যারা নিয়ন্ত্রণ করে, তারা বোধহয় এটাকে অন্যভাবে দেখতে চায়। মানুষ বুঝছে যে, বেঁচে থাকা আসলে কত কষ্টের। আমার এই অ্যালবামকে বিভিন্নরকমভাবে ব্যাখ্যা করা যায়। একটা গান কখনওই একটা মাত্র অর্থ তৈরি করতে পারে না, সে হাজারভাবে ভাবতে পারে- আলোচনা করতে পারে। গানগুলো শুনলে মানুষ আরও ভালো করে বুঝতে পারবেন কেন আমি পৃথিবীর ধ্বংসলীলা বলতে চাইছি এবং কোন পরিপ্রেক্ষিতে বলছি।

    বাংলাদেশে হার্ড রক ও মেটাল গানের শ্রোতা কেমন এই মুহূর্তে?

    সমগ্র বাংলাদেশ রক মিউজিক নির্ভর। সেখানে সবথেকে বেশি সাম্মানিক পাওয়া গায়কও একজন রকশিল্পী। বাংলাদেশে ব্যান্ড সংগীতের সূত্রপাত ঘটে আজম খান (মুক্তিযোদ্ধা মাহবুবুল হক আজম)-এর হাত ধরে। ব্যান্ড বলতে বাংলাদেশে প্রচলিত রক ঘরানার সংগীত ব্যান্ডই বোঝায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে আজম খানের গাওয়া পপ সংগীত সৈনিকদের উজ্জীবিত করতো। সেখান থেকেই একটু একটু করে গড়ে উঠেছিল ব্যান্ড সংগীত। আশির দশকে বাংলাদেশে এল হেভি মেটাল গান। এখনও বাংলাদেশের শ্রোতা রক গান শুনে ভীষণ উজ্জীবিত হন।

    গিটারিস্ট সেথ পান্ডুরাঙা ব্লুমবার্গের সঙ্গে প্রবর রিপন

    রক অ্যান্ড রোল একটা অনুভবের জায়গা। সেটা এক একজনকে তাঁদের মতো করে প্রভাবিত করে। একজন সংগীতশিল্পীর পূর্বপুরুষ সমস্ত ঘরানার সংগীতশিল্পীরাই।

    গানের মধ্যে কথা বা ভাষার স্পষ্টতা কতখানি জরুরি? কী মতামত আপনার?

    খুবই জরুরি। তবে এখানে আমি একটা কথা বলি। আমরা যখন মঞ্চে অনুষ্ঠান করি, তখন অনেকেই দেখবেন আমাদের সঙ্গে গেয়ে ওঠে। কেন? তাঁদের গানটা মুখস্থ আছে বলে। অতএব তাঁরা বহুবার গানটা শুনেছেন। সাউন্ড বা পারফর্ম্যান্সে যদি কোনো সমস্যা থেকেও থাকে, শ্রোতারা কিন্তু ঠিক বুঝে নেন। যাঁরা প্রথমবার আমাদের গান শুনছেন, তাঁদের কাছে অস্পষ্ট মনে হতেই পারে। লালন ফকিরের গান প্রথমবার শোনার পরেই কি আমরা সব কথা বুঝে যাই? বারবার শুনতে হয়, কথাগুলো উপলব্ধি করতে হয়। শুধু রক গান নয়, যেকোনো ধরনের গান যদি শ্রোতাদের শোনা না থাকে বা গানের সঙ্গে যদি পরিচিতি না থাকে, তাহলে প্রথমবারেই সব কথা বোঝা যায় না।

    পাশ্চাত্যের পিংক ফ্লয়েড, ভ্যান হ্যালেন, গানস অ্যান্ড রোজেস ইত্যাদি ব্যান্ডের গান আপনাকে কতটা প্রভাবিত করে?

    রক অ্যান্ড রোল একটা অনুভবের জায়গা। সেটা এক একজনকে তাঁদের মতো করে প্রভাবিত করে। একজন সংগীতশিল্পীর পূর্বপুরুষ সমস্ত ঘরানার সংগীতশিল্পীরাই। আপনি যাঁদের নাম করলেন, এঁরা সকলেই আমাদের ভীষণভাবে উদ্দীপ্ত করেছে সবসময়।

    ব্যক্তিগত স্তরে কেমন গান বা কাদের গান শুনতে পছন্দ করেন?

    বব ডিলান, ডোর্স, পিংক ফ্লয়েড, লেড জ্যাপলিন, জিমি হেন্ড্রিক্স, ব্ল্যাক মিউজিক, ব্লুজ-এর পাশাপাশি অনেক পছন্দ করি কবীর সুমন, মহীনের ঘোড়াগুলি, কিশোর কুমার, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, হেমাঙ্গ বিশ্বাস, শচীন দেব বর্মন, সাগর সেন, দেবব্রত বিশ্বাস প্রমুখদের গান।

    লোকসংগীত আপনাকে কতখানি প্রভাবিত করে?

    সব সংগীতই লোকসংগীত। কারণ সব গানই লোকে গাইছে। আমি যেহেতু পূর্ববঙ্গের মানুষ, বাউলাঙ্গের গানই তো আমাদের শিকড়। আমরা নতুন অ্যালবামের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি, সেখানে অনেক লোকায়ত জিনিস থাকবে। আর একটা জিনিস আপনাকে বলি, ‘সোনার বাংলা সার্কাস’-এর ‘মৃত্যু উৎপাদন কারখানা’ও কিন্তু একটা লোকগান, অ্যারাবিয়ান লোকগানের অংশ। আবার ‘আত্মহত্যার গান’-এর মধ্যে ইউরোপিয়ান অপেরার প্রভাব আছে।

    সোনার বাংলা সার্কাসের অ্যালবাম হায়েনা এক্সপ্রেস-এর একটি গান

    প্রেসিডেন্সিতে মহীনের বাপিদার জন্য অনুষ্ঠান করলেন। বাপিদার সঙ্গে আপনার কেমন যোগাযোগ? আর যোগাযোগের সেতুটা কী?

    বাপিদার সঙ্গে একবারই কথা হয়েছে। কিন্তু গানের দিক দিয়ে তো কত ইমোশনাল যোগাযোগ! ওঁদের মতো কিংবদন্তিদের গান শুনে বড়ো হয়েছি। ফেসবুকে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল আমাদের।

    মহীনের ঘোড়াগুলি থেকে রূপম ইসলাম — কলকাতা আপনার গান-জীবনে কেমন ভাবে জড়িয়ে আছে?

    আমি তো গানের মধ্যে ভাগাভাগি করিনি কখনও। গানের কোনো মানচিত্র হয় না। এটা বাংলাদেশের গান, ওটা পশ্চিমবাংলার গান এইভাবে ভাবিওনি। গানকে সবসময় দেখেছি বাংলার গান বা বাঙালির গান হিসেবে। তাই ঢাকা হোক বা কলকাতা – সব গানগুলোকে শুষে নিয়েছি। মহীনের ঘোড়াগুলি বা কবীর সুমনকে যেভাবে পাগলের মতো শুনেছি, সেভাবেই আজম খান, আইয়ুব বাচ্চু, জেমসকে শুনেছি।

    আমি ঝিনাইদহ জেলার মধুপুর গ্রামে বড়ো হয়েছি। তার উত্তরে কুষ্টিয়া জেলা। যেখানে লালন ফকিরকে নিয়ে এখনও প্রভূত চর্চা হয়। সেখানে প্রত্যেক মানুষের জীবনে গান জড়িয়ে আছে। কলকাতা যেমনভাবে আমায় অনুপ্রাণিত করেছে, কুষ্টিয়াও সমানভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে।

    ____

    ছবি সৌজন্যে: প্রবর রিপন

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @