No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    আধুনিক বাংলা গান এত সমাজবিমুখ কেন? 

    আধুনিক বাংলা গান এত সমাজবিমুখ কেন? 

    Story image

    (‘বিদ্যাসাগরের বিধবাবিবাহ আন্দোলনকে বিদ্রুপ করে বাঁধা হয়েছিল জনপ্রিয় সব গান’-এর পরবর্তী পর্ব) 


    কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পরের গানে, যাকে আমরা সচরাচর আধুনিক বাংলা গান বলে চিহ্নিত করি (যেন রবীন্দ্রনাথের গান প্রাগৈতিহাসিক!), সমাজভাবনার ইশারা প্রায় নেই। যেহেতু, বাংলা গানের সমাজতত্ত্ব নিয়ে সত্যি অর্থে কোনও নিবিড় গবেষণা হয়নি (কোনোদিন হবে বলেও মনে হয় না), ফলে এর কারণটা আমরা কখনও জানতে পারব না। কিন্তু গানের যে সব দৃষ্টান্ত আমাদের সামনে আজও উজ্জ্বল, যাকে আমরা আদর করে স্বর্ণযুগের গান বলি, তার শরীরে ‘যুগ’-এর পদচিহ্ন প্রায় গরহাজির। তলিয়ে দেখলে দেখা যাবে, তিরিশের দশক থেকে বাংলা আধুনিক গান তার ভাব ও ভাষার ঘরানায় রবীন্দ্রনাথকে অনুসরণ করেছে, পরের দিকে নজরুল ইসলামের মানসিক স্থবিরতা থেকে যে শূন্যতা, তার দখল নিয়েছেন যে গীতিকাররা, তাঁরা গানের ভাষা ও উপাদানে লিরিকধর্মী ও রোমান্টিক – কিন্তু রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের সময়ভাবনার অভিক্ষেপ তাঁদের গানে তেমনভাবে পড়েনি। ‘চরণ ফেলিও ধীরে ধীরে প্রিয়, আমার সমাধি পরে”, “চাঁদ কহে চামেলি গো” বা “এমনই বরষা ছিল সেদিন” – এইসব আবেগী রোমান্টিকতার রচনা যখন বাংলা গানে ডানা মেলছে, তখন দেশের মাটিতে স্বাধীনতার লড়াই তুঙ্গে। গান সেই সময়ে একটুও ধরতে পারেনি। খুব কষ্ট করে মনে করা যায় একটা গান, “আমি দুরন্ত বৈশাখী ঝড় / তুমি যে বহ্নিশিখা”। তবে এটা ব্যতিক্রম বলেই নিয়মকে প্রমাণ করবে। 

    বরং ১৯৪৩-এর মন্বন্তর ও তার আগের রাজনৈতিক সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে বাংলা গণসংগীতের যে সূচনা, তা অনেক বেশি স্পর্শ করেছিল সমসময়কে। বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শ তার সীমানা নির্ধারণ করলেও এই গান তার সাংস্কৃতিক আন্দোলনের আবহে বাংলা গানের মধ্যে সময়ের অন্য একটা মাত্রা প্রবৃষ্ট করে দেয়। যে ধারাবাহিকতা প্রায় সত্তরের শেষার্ধ অবধি একটা সজীব ধারা হিসেবেই ছিল। যদিও এই গানে ‘রাজনীতির ছোঁয়াচ’ থাকায় তা কোনও প্রাতিষ্ঠানিক প্রশ্রয় পায়নি। বেতারে বা চলচ্চিত্রে এই গান প্রচারিত হত না, গ্রামাফোন কোম্পানিও এই ধরনের গান বহুদিন অবধি রেকর্ড করেনি। তাছাড়া গণসংগীতের একবগগা অভিমুখের বিরোধিতা করে সলিল চৌধুরী ও আরও অনেকে দলছুট, বাকিরাও কেউ কেউ এলোমেলো। তবু, ভাবনার সূত্রে সলিল হাল ছাড়েননি। নিজের ছোটো মেয়ে অন্তরাকে নিয়ে সাতের দশকের শেষে রেকর্ড করিয়েছিলেন অন্যরকম গান – “মা গো মা, অন্য কিছুর গল্প বলো / এক যে ছিল রাজা রানি অনেক হল”। সরাসরি রাজনৈতিক উচ্চারণ না হলেও তির্যকভাবে এইসব গানে একটা সামাজিক উপাদান ছিল, যা সমকালীন বাংলা আধুনিক গান বা ফিল্মি গানে প্রায় অনুপস্থিত। পঞ্চাশ থেকে আশি, বাংলার সামাজিক রাজনৈতিক জীবনে কম ঢেউ ওঠেনি, কিন্তু এমন অন্যধারার গান কই? আবারও মনে করব অন্তত তিনটি গানের কথা, যেখানে দেখা যাবে কিছু ব্যতিক্রমী উচ্চারণ – মোহিনী চৌধুরীর লেখা “মুক্তির মন্দির সোপান তলে”, “পৃথিবী আমারে চায় / রেখো না বেঁধে আমায়”, আর কিছু পরে, জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের লেখা ও সুরে, “এ কোন সকাল / রাতের চেয়েও চেয়েও অন্ধকার”। তিরিশ বছরে তিনটে। এটাকে কি ইতিহাসের ট্রাজিক নিয়তি বলা যাবে না? 

    বাংলা গানের সমাজতত্ত্ব নিয়ে ভাবতে বসলে শুধু এইটুকু বললেই চলবে না। কেননা সমাজ কোনও স্থায়ী বিগ্রহমূর্তি নয়, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা পাল্টে পাল্টে যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্যবর্তী সময়ে যে সমাজ-বাস্তবতা, প্রায় চল্লিশ পঞ্চাশ বছরে তার আদল কোনওভাবেই এক নয়। এক হতে পারে না। কিন্তু বাংলা গণসংগীত, যা কোনও বিশেষ যুগমুহূর্তের দাবিতে তৈরি হয়েছিল, তা কিন্তু পাল্টায়নি। এ এক অদ্ভূত বৈপরীত্য। আধুনিক বাংলা গানের মূল স্রোত যখন সময়ছুট হয়ে আপনভোলা এক প্রেম প্রকৃতির রক্তহীন ধারায়নিমগ্ন, যেখানে তার অনেক জরুরি প্রশ্ন, “ও কেন এত সুন্দরী হল?” অথবা তার অবলোকন “ভালোবাসার রাজপ্রাসাদে নিশুতি রাত গুমরে কাঁদে”, কিংবা তার দুঃখবিলাস “আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি”। এইসব গানের কথা, সুর, বা গায়কি নিয়ে এক ইঞ্চি সমালোচনার অধিকার আমার নেই, সে বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ সচেতন। কিন্তু শুধু এ-ই বাংলা গান? ষাটের দশকে সারা পৃথিবী জুড়ে ভাঙচুড়, নারী-আন্দোলনে খোদ ইউরোপ-আমেরিকা উত্তাল, ভিয়েতনাম যুদ্ধ নিয়ে সারা দুনিয়ার জনমত স্যামচাচার বিরুদ্ধে, জাঁ পল সাত্রে-র মতো মানুষ পথে নেমেছেনও, আর বাংলা গানে তখন গাওয়া হচ্ছে “মায়াবতী মেঘে এল তন্দ্রা”? এইকথা বলছি না, সবাইকেই এক রকম গান লিখতে হবে, সবাই সমকালকে নিয়ে লিখবেন। কিন্তু একটা ভাষার গানের মানচিত্রে সব রকম স্বরই তো থাকা দরকার। দশজন যদি লেখেন “সেদিনের সোনাঝরা সন্ধ্যা”, তখন এক-আধজনও কি লিখবেন না, নাপাম বোমা দিয়ে কীভাবে মার্কিনি সেনা ধ্বংস করে দিচ্ছে ভিয়েতনামের গ্রামের পর গ্রাম! আমাদের বাংলা ভাষাতেও তো তখন পিরানদেল্লোর নাটক মঞ্চস্থ হচ্ছে, শম্ভু মিত্র তারও আগে করেছেন ‘পুতুলখেলা’। সত্যজিৎ রায় ‘মহানগর’-এ ধরতে চাইছেন বাঙালি মধ্যবিত্তের আর্থিক সংকট ও একান্নবর্তী পরিবারের ভাঙনচিত্র।  অথচ এই কলকাতা শহরেই তখন বাংলা ফিল্মের গানে গাওয়া হচ্ছে “তুমি যে আমার, ওগো তুমি যে আমার”! হায় বাংলা গান, তুমি কি পথ হারাইয়াছ?

    এদিকে গণসংগীতেও তখন এক স্থিতবস্থা। সময়কে ছুঁয়ে থাকা মানে সব দরজা জানলা বন্ধ করে স্থবিরতার সাধনা নিশ্চয়ই নয়। অথচ সময়ের যে সব চিহ্ন ইউরোপের আমেরিকার লোকসংগীতকাররা ধরতে পারছিলেন তাঁদের গানে, এখানে তেমন গান হল কই? অনেককাল আগে হেমাঙ্গ বিশ্বাস ‘শঙ্খচিল’ লিখেছিলেন আণবিক বোমার ভয়াবহতাকে সামনে রেখে, কিন্তু তার পরেও সারা বিশ্বজুড়ে অস্ত্রের দাপাদাপি , সেখানে পিট সিগার লিখতে পারেন “ওয়ান ব্লু স্কাই অ্যাবভ আস”, কিন্তু বাংলা গণসংগীতে তার তেমন বার্তা থাকে না। জনন লেনন যখন ‘ইমাজিন’ –এর মতো গান লেখেন, বব ডিলান লেখেন ‘হার্ড রেইন’, আর পাশে পাশে সময়কে ছুঁয়ে থাকার অজুহাতে ফাটা রেকর্ডের মতো ‘যুদ্ধ নয় শান্তি চাই’-এর উচ্চারণ বাংলা গণসংগীতকে ক্রমশ বিবর্ণ করে। এমনকি “রুশ দেশের কমরেড লেনিন / মাটিতে কবরে শয়ান”-এর মতো চমৎকার গানও (ল্যাংস্টন হিউজের কবিতা অবলম্বনে কবি বিষ্ণু দে-র লেখা) কেমন যেন পানসে লাগে, কারণ, ততদিনে সোভিয়েট রাশিয়াও লাল চিনের বিচারে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছে ‘সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ অভিধায়। আবার চিনের লোকগাথা অবলম্বনে ‘বোকা বুড়োর পাঁচালি’, যা সত্তরের দশকে যথেষ্ঠ জনপ্রিয় হয়েছিল, পরে একরকম ভাবে হারিয়ে ফেলল তার প্রাসঙ্গিকতা। কারণ, ততদিনে চিনের প্রাচীরেও ধরা পড়েছে নানান ফাটল। আসলে গানকে সময়ের সঙ্গে চলতে হয়, সময়ের নানা বিভঙ্গকে তার মধ্যে ঠাঁই করে দিতে হয়। তাঁর এক লেখায়, সংগীতের মধ্যে “এতদূর পর্যন্ত সামর্থ্য থাকার” কথা আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু আরও পাঁচটা বিষয়ের মতো এইসব কথা মনে রাখার কোনও গরজ আমাদের কোনও কালেই ছিল না, এখনও নেই। এটা একটা জাতির দুর্বলতা। কোনও ব্যক্তিবিশেষকে গাল পেড়ে লাভ নেই।

    তাছাড়া ইতিহাস তো কোনও পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে চলে এমন নয়, তার একটা চালিকাশক্তি আছে নিশ্চয়ই, কিন্তু শিল্পসাহিত্যের ক্ষেত্রে এই শক্তিটা খুব সূক্ষ কতকগুলো বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। গবেষণা ও নিবিড় চর্চার অনুশীলনে তার এই স্তরগুলো উন্মোচিত হতে থাকে। কিন্তু বাংলা গান তো সেই প্রথাগত ধারার বাইরে এক বিচিত্র বাস্তবতায় বেঁচে আছে। ইদানীংকালে বিশ্বায়িত পৃথিবীতে আর যাই হোক, প্রযুক্তির কল্যাণে গান শোনার আয়োজনের অভাব নেই। রাস্তাঘাটে, বাজারে, মেট্রো রেলের সিঁড়িতে শপিং মলের বারান্দায়, বাসে, ট্রেনে, অটোতে, ফুটপাতে ফুচকা বা ভেলপুরি খেতে খেতেও মানুষ গান শুনছেন। এত মানুষ গান শুনলে গানের জোগান বাড়াতেই হয়। বাড়াতে হয় বৈচিত্র্য। হচ্ছেও। উদার অর্থনীতির একটা মূল লক্ষ্য হল ভোক্তার সামনে অপশন বাড়িয়ে যাওয়া – গানও তার বাইরে নয়। ফলে রবীন্দ্রনাথ থেকে রিমেক, ফিউশন থেকে লুঙ্গি ড্যান্স পর্যন্ত আমাদের বাংলা গানের দিগন্ত এখন ক্রমশ উন্মোচিত। এর মধ্যে বাংলা গানের সমাজতত্ত্বের মতো বেয়াড়া প্রসঙ্গ না হয় আপাতত শিকেয় তোলাই থাক! 
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @