৬৩ বছর ধরে ষোলো রকম মাছের স্বাদ আদর্শ হিন্দু হোটেলে

পুরোনো একফালি ঘর। দেওয়ালের একপাশে ক্যালেন্ডার। তাতে লেখা ‘কালীমাতা সহায়’। গোল ঘর জুড়ে সারি সারি চেয়ার-টেবিল। শালপাতা আর মাটির ভাঁড় বুঝিয়ে দিচ্ছে বাঙালির নিজস্ব আভিজাত্য। চারদিক ম-ম করছে সুস্বাদু গন্ধে। খাদ্যপ্রিয় রসিক বাঙালিদের জন্য আদর্শ জায়গা। এই ‘আদর্শ’ শব্দটির সঙ্গে বাঙালির পরিচয় অনেকদিনের। আজ থেকে প্রায় ৮১ বছর আগে, ১৯৪০ সালে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখে গিয়েছিলেন ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’। তারপর এই নাম ভুলতে পারল না বাঙালি। দক্ষিণ কলকাতার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র গড়িয়াহাট কমপ্লেক্সের ঠিক দোতলায় রয়েছে ‘আদর্শ হিন্দু হোটেল’।
আদর্শ হিন্দু হোটেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন কালিপদ মাইতি। ওঁর ছেলে তরুণ মাইতি বর্তমান মালিক। এই পাইস হোটেলের বয়স প্রায় ৬৩ বছর। ৬৩ বছর ধরেই ব্যবহার করা হয় শালপাতা এবং মাটির ভাঁড়। প্রায় পনেরো থেকে ষোল রকমের মাছের পদ, চার রকমের সবজি, তিনরকম ভাজা, চাটনি, ডাল, দই, মিষ্টি, পাঁপড় সবকিছুই পাওয়া যায়। সকাল ৯টা থেকেই তৈরি হয়ে যায় সমস্ত পদ, বিকেল ৪-৩০টে নাগাদ বন্ধ হয়। আবার সন্ধে ৭টায় দোকান খোলে, চলে রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। তবে রাত্রে ভাত নয়, রুটি পাওয়া যায়। সঙ্গে বাহারি তরকা, চানা মশলা।
গড়িয়াহাট কমপ্লেক্সের নতুন বিল্ডিঙের দোতলায় যে কাউকে জিজ্ঞাসা করলেই পেয়ে যাবেন এই হোটেলের খোঁজ। পাবেন অ্যাকুয়াগার্ডের জলও। বিশেষ মাছের পদের মধ্যে পাবেন কইমাছের তেলঝাল, কুচো মাছের চচ্চড়ি, ট্যাংরা মাছের ঝোল। এমনকি খাসির মাংসও নাকি অনবদ্য। শালপাতায় ভাত, মাটির ভাঁড়ে জল তার সঙ্গে নানান মশলা ব্যঞ্জনে তৈরি সুস্বাদু সবজি, মাছ, মাংস বা ডিম। আহা! কলকাতা শহর থেকে প্রায় অবলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে শালপাতা, কলাপাতা বা মাটির ভাঁড়ে খাবার দেওয়ার রীতি। সেখানে পুরোনো কিছু পাইস হোটেলের পক্ষেই সম্ভব এই ধরনের সংস্কৃতি জিইয়ে রাখা।
আরও পড়ুন: কাঁচালঙ্কার রসগোল্লা!
আদর্শ হিন্দু হোটেলে নিয়মিত খাবার খান ৬৫ বছর বয়সী জ্যোতির্ময় তরফদার। এখনও তিনি আঁকড়ে রয়েছেন স্মৃতির পাহাড়। তিনি বলেন, “গত পঁয়ত্রিশ বছর ধরে আমি এই হোটেলে খেতে আসি। বিয়ে করিনি। রান্নাও বিশেষ জানি না। আমার মতো খাদ্যপ্রিয় মানুষের কাছে আদর্শ হিন্দু হোটেলই আদর্শ জায়গা। আশি-নব্বইয়ের দশকে আসতাম বন্ধুদের সঙ্গে। তাঁদের অনেকেই এক এক করে প্রয়াত হয়েছেন। আমাকে ছেড়ে একা করে চলে গেছেন। এই হোটেলে এলে দেখি কত তরুণ-তরুণী এসে খাচ্ছে, আড্ডা মারছে, খাবার নিয়ে তর্ক করছে। কত কত পুরোনো কথা মনে পড়ে যায়।” এরকম অসংখ্য একা মানুষের যে যে জায়গাগুলো কলকাতাকে প্রাণ দেয়, আরও সজীব করে রাখে, নিঃসন্দেহে আদর্শ হিন্দু হোটেল সেসবের মধ্যে অন্যতম জায়গা।
আসলে ভরদুপুরে ভাত ছাড়া বাঙালির ঠিক জমে না। আর গড়িয়াহাট চত্বরে ভাতের হোটেল বলতে সবার আগে যে নামটা আসে, সে আদর্শ হিন্দু হোটেল। হোটেলের ঠিকানা – ২১২, রাসবিহারী অ্যাভিনিউ, গড়িয়াহাট মার্কেট। কোভিডকালে লকডাউনের জেরে বেশ কিছু মাস বন্ধ থাকলেও, বর্তমানে আবার স্বমহিমায় ফিরেছে আদর্শ। লোকজনও হচ্ছে দেখার মতো। লকডাউনের পর সরকারি সমস্ত স্বাস্থ্যবিধি এখানে মানা হচ্ছে বলে জানান ক্রেতারা। আদর্শে এসে আপনি চেখে দেখতে পারেন সাধারণ নিরামিষ খাবার থেকে রুই কালিয়া, কাতলা কালিয়া, তেলাপিয়া, চারাপোনা, কাটাপোনা, পার্সে, পাবদা, ইলিশ ভাপা, চিকেন কারি, মটন কারি। প্রত্যেকটি পদই ভীষণভাবে পকেট ফ্রেন্ডলি। পুরোনো কলকাতার মোহ এখনও নেশার মতো ঘিরে রাখে একদল বাঙালিকে। সেইসব ইতিহাসের পাশে চুপ করে কিছুক্ষণ বসে থাকতে কার না ভালো লাগে বলুন! খাবার স্বাদ আর গন্ধের মেলবন্ধন আপনাকে ‘আদর্শ’ উপহার দেবে ঠিক। পুরোনো কলকাতার বুকে এই ঐতিহ্যবাহী আদর্শ হিন্দু হোটেল আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছে।