৬-৬টি নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে একটাই শহর—কলকাতা

অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। ফের এক বঙ্গসন্তান, ফের অর্থনীতি। ঘটনাচক্রে, অভিজিৎ অমর্ত্য সেনেরই ছাত্র। কলকাতার বাসিন্দা, সাউথ পয়েন্ট স্কুল আর প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। এখন আমেরিকা-প্রবাসী। তাতে কী! ঝরঝরে বাংলা বলেন, ধুতি-পাঞ্জাবি-জহর কোটে শোভিত হয়ে পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে যখন বাংলায় বক্তৃতা দেন, তখন বাঙালি শিকড়টা জ্বলজ্বল করে। এপার-ওপার বাংলা মিলিয়ে চারজন বাঙালি এখনো অবধি নোবেল পেয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অমর্ত্য সেন, মহম্মদ ইউনূস আর এই তালিকায় সর্বশেষ সংযোজন অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। এ তো গেল ‘বাঙালি’-র সঙ্গে নোবেল পুরস্কারের সম্পর্ক। কলকাতা শহরের সঙ্গেও কিন্তু নোবেল পুরস্কারের একটা বিশেষ সম্পর্ক আছে। ছ-ছ’টি নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই শহর। ভারতে এমন শহর আর একটাও মিলবে না।
ছ’জন নোবেল প্রাপক কে কে? প্রথমজন একজন সাহেব—রোনাল্ড রস। তারপর একে-একে রবীন্দ্রনাথ, চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন, মাদার টেরেজা, অমর্ত্য সেন এবং অভিজিৎ। এই তালিকায় তিনজন অবাঙালি। কিন্তু, প্রত্যেকের নোবেল-প্রাপ্তির সঙ্গেই কোনো না কোনোভাবে জড়িয়ে কলকাতা শহর। কখনো জন্মস্থান হিসেবে, কখনো বা কর্মক্ষেত্র হিসেবে। এ যেন এক বহমান সমাপতনের গল্প।
আরো পড়ুন
পলিফ্লাওয়ার থেকে ‘ব্যানার্জিস পালং-- মানবজমিনেও সোনা ফলাতেন প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র শিবপ্রসাদ
রোনাল্ড রসের কথাই ধরা যাক। সাহেবের জন্ম ভারতের আলমোড়ায়। কেমব্রিজ এবং অক্সফোর্ড দুই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়েই ঢুঁ মেরেছেন ছাত্র হিসেবে। ভালো আঁকতেন, সুরে দখল ছিল, লিখতেনও চমৎকার। ইতিহাস, দর্শন, গ্রিক-রোমান সাহিত্যে গভীর পাণ্ডিত্য ছিল তাঁর। লিভারপুল বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনাও করেছেন কিছুকাল। এহেন মানুষটি ‘আর্মি মেডিক্যাল সার্ভিসে’ চাকরি নিয়ে চলে এলেন ভারতে। তারপর একসময় কলকাতায়। ম্যালেরিয়া তখন প্রাণঘাতী অসুখ। ল্যাভেরন সাহেব ম্যালেরিয়ার সঙ্গে মশার যোগসূত্র থাকার কথা বলেছিলেন। রোনাল্ড রস আগেই শুরু করেছিলেন ম্যালেরিয়া নিয়ে গবেষণা। কলকাতার প্রেসিডেন্সি হাসপাতালের (অধুনা এসএসকেএম হাসপাতাল) গবেষণাগারেও চলল মশা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা। সেখানে তাঁর গবেষণার অন্যতম সহকারী ছিলেন বিজ্ঞানী ও স্বাধীনতা সংগ্রামী কিশোরী মোহন বন্দ্যোপাধ্যায়। পাখির ওপরেও পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন রস। অবশেষে প্রমাণিত হল, ম্যালেরিয়া ছড়ানোর পেছনে দায়ী প্রধান পতঙ্গ স্ত্রী অ্যানোফিলিস মশা। এই যুগান্তকারী আবিষ্কারের স্বীকৃতি-স্বরূপ প্রথম ব্রিটিশ হিসেবে নোবেল পেলেন রোনাল্ড রস, ১৯০২ সালে। আর সেই আবিষ্কারের সঙ্গে জড়িয়ে থাকল কলকাতা এবং অধুনা এসএসকেএম হাসপাতালের ছোটো ল্যাবরেটরি।
কলকাতার প্রেসিডেন্সি হাসপাতাল (অধুনা এসএসকেএম হাসপাতাল)-এর সামনে রোনাল্ড রস
১৯০২-এর পর ১৯১৩। এবারে একেবারে শহরের নিজের সন্তান, বাঙালি। প্রথম অ-ইউরোপীয়, প্রথম কালো চামড়ার মানুষ হিসেবে সাহিত্যে নোবেল পেলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি থেকে একটা মানুষ পৌঁছে গেলেন গোটা বিশ্বের কাছে। নোবেল-প্রাপ্তির পর ইংরেজি অনুবাদে তাঁকে পড়তে শুরু করল ইংল্যান্ড, আমেরিকা। তারপর ক্রমে আরো একাধিক ভাষায় অনুবাদ। স্প্যানিশ কবি হিমেনেথ আর তাঁর স্ত্রী সেনোবিয়া আজীবন চর্চা করে গেছেন রবীন্দ্র-সাহিত্য। বাংলার শ্রেষ্ঠ সন্তানের হাত ধরে ফের বিশ্বের সামনে পরিচিত হল ব্রিটিশ ভারতের একদা রাজধানী কলকাতা। আগেরবারের তুলনায় এবারে গর্ব নিঃসন্দেহে অনেক বেশি হয়েছিল তিলোত্তমার। নিজের ভূমিসন্তান বলে কথা।
এরপর ১৯৩০। ফের গর্বিত হল কলকাতা। প্রথম এশিয় হিসেবে পদার্থবিদ্যায় নোবেল পেলেন চন্দ্রশেখর ভেঙ্কট রামন। মাদ্রাজের প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র রামন ১৯১৭ সালে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। অবশ্য, তাঁর কলকাতা-সংযোগ আরো আগের। ১৯০৭-১৯৩৩ পর্যন্ত বৌবাজারের ‘ইন্ডিয়ান অ্যাশোসিয়েশন ফর দ্য কালটিভেশন অব সায়েন্স’-এর সঙ্গে জড়িয়ে তিনি। বিখ্যাত ‘রামন এফেক্ট’-এর আবিষ্কারের সঙ্গে তাই ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে এই শহরও।
১৯৭৯ সালে শান্তির জন্য নোবেল পুরস্কার পেলেন মাদার টেরেজা। জন্মসূত্রে আলবেনিয়ান এই সন্ন্যাসিনীকে মা হিসেবেই গ্রহণ করেছিল আপামর শহরবাসী। ১৯৫০-এ মিশনারিজ অব চ্যারিটি প্রতিষ্ঠা করেন মাদার। মূলমন্ত্র সেবা ও শান্তি, মাদার নির্ভয়ে নেমে পড়েছিলেন দাঙ্গা-বিধ্বস্ত কলকাতার পথেও। বাংলা বলতেন স্পষ্ট। এ তাঁর নিজেরই শহর। তাঁকেও কখনো বিদেশিনী ভাবেনি কলকাতা।
অমর্ত্য সেনের সঙ্গে কলকাতার যোগসূত্র প্রেসিডেন্সি কলেজ। ১৯৫৩ সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে স্নাতক হন অমর্ত্য। তারপর মাত্র ২৩ বছর বয়সে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা এবং অধ্যাপক হিসেবে নিযুক্ত হন। যাদবপুরকে কলকাতা বললে অত্যূক্তি হবে কি? প্রেসিডেন্সি ও যাদবপুর—কলকাতার এই দুই গর্বের প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে অমর্ত্য সেনের নাম।
আর, তাঁর ছাত্র অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় তো খোদ কলকাতারই সন্তান। মা নির্মলা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং বাবা দীপক বন্দ্যোপাধ্যায়—দুজনেই অর্থিনীতির অধ্যাপক। অভিজিতের স্কুল সাউথ পয়েন্ট, কলেজ প্রেসিডেন্সি। তাঁর নিজের বাড়ি এই শহরে, শিকড়ও। অভিজিৎকে নিজের ভূমিসন্তান ভাবতে সামান্যও সংকোচবোধ করে না এই শহর।
কল্লোলিনী তিলোত্তমা। কত ইতিহাস এর গলিতে-ঘুঁজিতে, গঙ্গার ঘাটে, প্রাচীন ইমারতের গায়ে। কত্ত গৌরব আজো বহন করে চলেছে এই মেট্রোপলিস। সেই গৌরবের মধ্যেই অন্যতম উজ্জ্বল এই ছ-ছটি নক্ষত্র। কলকাতার সঙ্গে ভবিষ্যতেও হয়তো জড়িয়ে যাবে কোনো নোবেল-প্রাপকের নাম। ফের গর্বিত হবে এই বুড়ো শহর। এই গৌরবে গোটা ভারতবর্ষে তার আর কোনো সমকক্ষ নেই।