পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ে সীতাকুণ্ডের পিছনে লুকিয়ে কোন গল্প?

প্রকৃতি তার আপন খেয়ালে জঙ্গল-পাহাড়-ঝর্নায় মায়াবী করে সাজিয়ে তুলেছে পুরুলিয়াকে। শহরের কোলাহল থেকে অনেক দূরে কয়েক দিনের জন্য হারিয়ে যেতে চাইলে শিমুল-পলাশে ভরা এই জেলার কোনো বিকল্প নেই। পুরুলিয়ার এক প্রধান আকর্ষণ অযোধ্যা পাহাড়। দলমা পাহাড়ের একটি অংশ এবং পূর্বঘাট পর্বতমালার একটি সম্প্রসারিত অংশ এটি। বেশ কয়েকটি চূড়া রয়েছে এই পাহাড়ে। তার মধ্যে সবচেয়ে উঁচু হল গোরগাবুরু। সমস্ত পাহাড়টির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বড়ো মনোরম। চারদিকে শুধু জঙ্গল আর জঙ্গল – মাঝে মাঝে আদিবাসীদের গ্রাম, চাষের জমি। ছৌ মুখোশের জন্য বিখ্যাত চড়িদা গ্রামের অবস্থান এই পাহাড়ের কোলেই। এছাড়াও ময়ূর পাহাড়, টুর্গা এবং বামনি ঝর্নার মতো বেশ কিছু দেখার জায়গা অযোধ্যা পাহাড়ে আছে।
অযোধ্যা পাহাড়ের হিলটপ অঞ্চলের কাছেই বাগান্ডি গ্রাম। সেখানে হাঁটাপথে গেলে পাওয়া যাবে পাথর দিয়ে বাঁধানো ঠান্ডা জলের এক প্রস্রবণ। এটি ‘সীতাকুণ্ড’ নামে পরিচিত। পুরুলিয়া শহর থেকে ৪৭ কিলোমিটার দূরে এর অবস্থান। মাটির নিচ থেকে অনবরত বেরিয়ে আসছে স্বচ্ছ পরিষ্কার শীতল জল। মাছও খেলা করছে সেখানে। স্থানীয় মানুষেরা বলে থাকেন, ত্রেতাযুগে বনবাসের সময়ে এখানে কয়েকদিন ছিলেন রামচন্দ্র ও সীতাদেবী। সীতা তৃষ্ণার্থ হয়ে পড়লে তির ছুঁড়ে মাটি ভেদ করে জল বের করে আনেন রামচন্দ্র। এখনও বেরিয়ে চলেছে সেই জল। প্রত্যেক বছর বৈশাখ মাসের পূর্ণিমা তিথিতে স্থানীয় আদিবাসীরা এখানে পশু শিকারের উৎসবে মেতে ওঠেন। তাঁদের কাছে জায়গাটা খুবই পবিত্র। সীতাকুণ্ডের কাছেই রয়েছে এক রামমন্দির। প্রস্রবণের আরেকটি মুখ এখন বিপর্যস্ত। সেখান থেকে আর জল বের হয় না।
গ্রীষ্মকাল শুরু হলে আশেপাশে পাহাড়ের নলকূপ এবং কুয়োগুলো শুকিয়ে যেতে থাকে। সীতাকুণ্ডের জল কিন্তু শুকোয় না। চারপাশের মানুষদের তৃষ্ণা মেটায় এখানকার ঠান্ডা জল। এটি আসলে একটি আর্টেজীয় কূপ। আর্টেজীয় কূপের ক্ষেত্রে, মাটির নিচে আধখানা চাঁদের আকারে দুটি অপ্রবেশ্য শিলাস্তরের মাঝখানে প্রবেশ্য শিলাস্তরে এমনভাবে জল জমে, জলের থাকে প্রবল চাপ। কুয়ো খুঁড়লে বা অন্য কোনো ফাঁক তৈরি হলে পাম্পের সাহায্য ছাড়াই সেই জল বেরিয়ে আসে।
পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড় ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশের আরও অনেক জায়গায় সীতাকুণ্ড দেখা যায়। উত্তরপ্রদেশের সুলতানপুর, বিন্ধ্যাচল, সীতামারী, বিহারের মুঙ্গের, ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ, বাংলাদেশের চট্টগ্রামেও পাওয়া যায় সীতাকুণ্ড। এই সব ক’টি জায়গা নিয়েই রয়েছে ত্রেতা যুগের সীতাদেবীকে নিয়ে কোনো না কোনো গল্প।
তথ্যঋণ – বিশ্বায়নী দত্ত, আশিস কুমার চট্টোপাধ্যায়।