পাহাড়ি পথের সিকিম

কালিম্পং-এর পাশেই সিকিমের অধীন জালেপলা সীমান্ত। একসময় কালিম্পং দিয়ে চিনের সঙ্গে বাণিজ্য হত জালেপলার মাধ্যমে। কিন্তু চিন-ভারত যুদ্ধের পর বন্ধ হয়ে যায় জালেপলা। পরে চালু হয় নাথুলা। কিন্তু পর্যটকদের কাছে জালেপলা লাগোয়া জুলুক, নাথাং ক্রমশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। গত তিন বছরে সিকিমে যত পর্যটক এসেছেন তার একটা বড় অংশ জুলুক রুটে ভ্রমণ করেছেন।
সমতল থেকে প্রায় ১১ হাজার ফুট উচ্চতায় রয়েছে এই জুলুক, নাথাং। পাহাড়ি রাস্তা সেখানে সাপের মতো এঁকেবেঁকে রয়েছে। একসঙ্গে পরপর রয়েছে ২২টি বাঁক যা দূর থেকে একটা অজগর সাপের মত মনে হয়। জুলুকের সঙ্গেই নাথাং ভ্যালি। সেখানে সুন্দর ল্যান্ডস্কেপ। পাহাড়ের সঙ্গে আছে বরফ, জঙ্গল। আরিটার হয়েই যেতে হয় সেখানে। এর মধ্যে আছে মেমেনছো লেক। তার গায়ে লাগানো লিঙ্কসে, বুলখার লেক। যেটা দেখতে হাতির মতো। সেখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে বেশ সুন্দর। সুন্দর পাহাড়ি ঝর্না, লেক, জঙ্গল, বরফ মিলিয়ে সেই রুটে ২৩টি স্থানে দাঁড়িয়ে ভালো ছবি তোলা যায়। আরিটার থেকে জুলুক আর কুপুপ তাই দিনকে দিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে বলে সিকিম সরকারের পর্যটন বিভাগের উপদেষ্টা তথা ভ্রমণ গবেষক রাজ বসু জানালেন।
আরও পড়ুন
চলুন যাই লামাহাট্টা

এই শীতে জুলুক ঘুরে এসে শিলিগুড়ি হায়দারপাড়া স্পোর্টিং ক্লাবের কর্মকর্তা নির্মল কুমার পাল জানালেন, বরফ, পাহাড়, সাপের মতো বাঁক সব মিলিয়ে দারুণ সেখানকার পরিবেশ। তবে এই জুলুক জনপ্রিয় হওয়ার আগে সেখান থেকে খানিক দূরে জালেপলা একসময় চিনের সঙ্গে বাণিজ্যের রুট ছিল। চিন বা তিব্বতের সঙ্গে বানিজ্য রুটের দুটি রাস্তা আছে। একটি সিকিমের গ্যাংটক হয়ে নাথুলা। আরেকটি জুলুক হয়ে জালেপলা। নাথুলা শুধু গ্রীষ্মে খোলা থাকত। আর জালেপলা খোলা থাকত সারা বছর ধরে। ব্রিটিশ আমলে কালিম্পং ছিল ভুটানের অধীনে। তাকদা থেকে ব্রিটিশরা পাহাড়ে তাদের চিন বা তিব্বতের ব্যবসা পরিচালনা করত। ইয়াং হাসবেন্ড প্রথম জালেপলা হয়ে তিব্বতে যান। সেই সময় শিলিগুড়ি লাগোয়া বৈকুন্ঠপুর জঙ্গলের পাশেই তিস্তা নদীতে নৌকা আসত। নৌকায় আসত পণ্য। সেখানে চমকদাঙ্গি লালতং আজও আছে। জলপাইগুড়ির রাজাকে সেই স্থানে পণ্য নামিয়ে কর দিতে হত। এরপর সেখান থেকে পণ্য নামিয়ে নিয়ে যাওয়া হত ডুয়ার্সের ওদলাবাড়ি হাটে। তখন ওদলাবাড়িতে বড় হাট বসত। সেই হাটে ভুটান রাজাকে কর দিয়ে খচ্চর বা ঘোড়ার পিঠে পণ্য চাপিয়ে চেল নদীর পাশ দিয়ে আলগরা হয়ে পণ্য নিয়ে যাওয়া হত জালেপলায়।
এখন আর সেই রাজা নেই। এখন আর সেই ঘোড়া বা খচ্চর নেই। নেই সেই নৌকাও। তার পরিবর্তে অনেক রাস্তা, অনেক যানবাহন, অনেক নতুন রুট খুলছে। কিন্তু চিন ভারত যুদ্ধে জালেপলা বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর তার গুরুত্ব কমে যায়। সিকিমের গ্যাংটক রুটই চলতে থাকে। কিন্তু পর্যটনের স্বার্থেই পেদং দিয়ে জুলুকের নতুন রুট খোলা হয়েছে। শিলিগুড়ি থেকে পেদং তিন বা চার ঘণ্টার রাস্তা। পেদং থেকে জুলুক ছয় ঘণ্টার রাস্তা। আবার পেদং রেনক বর্ডার হয়ে গ্যাংটক থেকে হিসাব করলে জুলুকের দুরত্ব ৭০ কিলোমিটার। ভ্রমণ গবেষক রাজ বসু বলেন, দিনকে দিন সুন্দর প্রকৃতি পরিবেশের জন্য জুলুক জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আর তাকে ঘিরে ৫০টিরও বেশি হোমস্টে হয়েছে। কিন্তু এখনও পুরোটাই অসংগঠিত হয়ে আছে। সেখানে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন এখন। আর এখনই তা না করা গেলে জুলুকের প্রতি ধীরে ধীরে আকর্ষণ হারাবে পর্যটকরা।