গ্রামের উৎসব-অনুষ্ঠানকে রঙিন করে তোলে শখের হাঁড়ি

মাটির বাসনপত্রের ব্যবহার মানুষ আদিম যুগ থেকেই করে আসছে। মাটির পাত্রকে নানা রঙে রাঙিয়ে তোলার ঐতিহ্যও খুব প্রাচীন। সিন্ধু সভ্যতার মানুষ রং করা ধূসর মাটির পাত্র ব্যবহার করতেন। মাটির জিনিসপত্রের ওপর নকশা করতেন বৈদিক যুগের মানুষেরা। বাংলার নানা জায়গায় মৌর্য, কুষাণ, গুপ্ত যুগের মাটির বাসন পাওয়া গেছে। ১৫ শতকে চিনা পর্যটক মা হুয়ান বাংলায় এসেছিলেন। বাংলায় তিনি রঙিন মাটির হাঁড়ি দেখেছিলেন।
এটি মূলত বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামীণ শিল্প
পোড়া মাটির রংবেরঙের হাঁড়ি বাংলা জুড়ে শখের হাঁড়ি নামে পরিচিত। এখনও বাংলার নানা জায়গায় গ্রামেগঞ্জে শখের হাঁড়ি পাওয়া যায়। এটি মূলত বরেন্দ্র অঞ্চলের গ্রামীণ শিল্প। পশ্চিমবঙ্গের মালদহ, শিলিগুড়ি, উত্তর দিনাজপুর, বাংলাদেশের রাজশাহী, নওগাঁ, গোয়ালন্দ, ঢাকা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লায় তৈরি হয় নানা ধরনের শখের হাঁড়ি। পশ্চিমবঙ্গের চেয়ে বাংলাদেশেই এই হাঁড়ির প্রচলন বেশি।
এখনও গ্রামীণ বাংলার মানুষজন নানা দৈনন্দিন কাজে মাটির হাঁড়ি ব্যবহার করেন। তবে সাধারণ গৃহস্থালির কাজে ব্যবহৃত মাটির হাঁড়ির সঙ্গে শখের হাঁড়ির পার্থক্য আছে। বাঙালি সারা বছর উৎসবে আমোদে মেতে থাকতে ভালোবাসেন। বছরের নানান উৎসবে কাজে লাগে শখের হাঁড়ি। বিয়ে এবং অন্যান্য সামাজিক অনুষ্ঠানে মিষ্টি কিংবা পিঠে ভর্তি শখের হাঁড়ি আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে উপহার পাঠানো হয়। স্বাদভক্ষণের সময়ে গর্ভবতী মহিলাদের ফল, মিষ্টি, মাছ ইত্যাদি দেওয়া হয় শখের হাঁড়িতে করে। এছাড়াও জন্মদিন, অন্নপ্রাশন, নববর্ষ, নবান্ন এবং অঞ্চলভেদে ভিন্ন ভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে এই হাঁড়ি কাজে লাগে।
শহুরে মানুষেরাও কখনো কখনো এই হাঁড়ি দিয়ে ঘর সাজিয়ে থাকেন
পাটের দড়ি দিয়ে রংবেরঙের হাঁড়িতে মুখরোচক খাবার শিকেয় টাঙিয়ে রাখেন গ্রামের মানুষ। এমনকি, জামা-কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্রও এই রঙিন হাঁড়িতে করে শিকেয় ঝোলানো থাকে। এখন শহুরে মানুষেরাও কখনো কখনো এই হাঁড়ি দিয়ে ঘর সাজিয়ে থাকেন। গ্রামের পুজো-পার্বণে যে সব মেলা বসে, সেগুলোতে শখের হাঁড়ির পসরা সাজিয়ে হাজির থাকেন শিল্পীরা। তবে, আগের থেকে এখন শখের হাঁড়ির ব্যবহার অনেক কমে এসেছে।
শৌখিন কাজে প্রচলন বলেই এর নাম শখের হাঁড়ি। বাংলার একেক অঞ্চলে শখের হাঁড়িতে নকশায় একেক রকম বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। অনেক রকম রঙে রাঙানো হয় হাঁড়িগুলোকে। আগে শখের হাঁড়িতে নকশা আঁকতে প্রকৃতি থেকে রং এবং আঠা জোগাড় করা হত। এখন রাসায়নিক রং দিয়েও আঁকা হয়। হাতি, ঘোড়া, ফুল, পাখি, মাছ, গাছপালার নকশায় সাজিয়ে তোলা হয় মাটির বাসনগুলোকে। আচার-অনুষ্ঠানের পার্থক্য অনুযায়ী শখের হাঁড়ি অনেক রকম হয়। যেমন - মঙ্গল হাঁড়ি, গর্ভ হাঁড়ি, আইবুড়ো হাঁড়ি, সাপুড়ে হাঁড়ি, ফুল হাঁড়ি জাগরণ হাঁড়ি। শখের হাঁড়ির বিচিত্র সব রঙিন নকশার জাদু গ্রামীণ অনুষ্ঠানগুলোকে আরও প্রাণবন্ত করে তোলে।
তথ্যঋণ – মোঃ এরশাদ আলী, মোঃ আমিরুল ইসলাম।