No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের ফলে পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছিল শিবনাথ শাস্ত্রীর  

    ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণের ফলে পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছিল শিবনাথ শাস্ত্রীর  

    Story image

    “আমি শৈশবাবধি বিদ্যাসাগরের চেলা” – নিজের সম্পর্কে একথাই বলতেন শিবনাথ শাস্ত্রী। উনিশ শতকের সমাজসংস্কার আন্দোলনে তাঁর অবদান ছড়িয়ে আছে পরতে পরতে। উনিশ শতক যে মুক্তচিন্তার জোয়ার এনেছিল, তাকে জীবনের প্রতিটি বিশ্বাসে ও কাজে জড়িয়ে নিয়েছিলেন তিনি। নিজের বিশ্বাস ও কাজে ফারাক রাখেননি। কিন্তু সে পথ খুব সহজ ছিল না। পরিবারের সঙ্গে বিচ্ছেদ, প্রথম স্ত্রীকে হারিয়ে ফেলা – মূল্য হিসেবে দিতে হয়েছিল এইসব।

    পিতা হরানন্দ ভট্টাচার্য ছিলেন বিদ্যাসাগরের অন্তরঙ্গ বন্ধু। সেই সূত্রে ছোটোবেলা থেকেই বিদ্যাসাগরের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ পেয়েছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী। প্রভাবিতও হয়েছিলেন গভীরভাবে। সেই থেকেই নীতিবোধ বা মূল্যবোধকে গুরুত্ব দিতে শিখেছিলেন। পিতা হরানন্দ ছিলেন অত্যন্ত বদমেজাজি। তাঁর মেজাজের জেরে প্রথম স্ত্রী (বালিকাবধূ) প্রসন্নময়ীর সঙ্গে বিচ্ছেদ ঘটেছিল শিবনাথের। পিতারই জেদের কারণে বিরাজমোহিনীকে বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিলেন। মাত্র আঠেরো-উনিশ বছর বয়স তখন তাঁর। তীব্র হতাশা তাঁকে গ্রাস করেছিল তখন। সেই সময়ই ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করেন তিনি। প্রসন্নময়ীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর লিখেছিলেন, “আত্মনিন্দাতে আমার মন অধীর হইয়া উঠিল। এই অবস্থাতে আমি ঈশ্বরের শরণাপন্ন হইলাম”। এখানেও পিতার সঙ্গে গভীর সংঘাতের উপক্রম হয়। কিন্তু যে কোনো কারণেই হোক, পিতার বজ্র-আঁটুনি ছিঁড়ে চিরতরে বেরিয়ে আসেন শিবনাথ।  

    তিনি যে বিদ্যাসাগরের যোগ্য চেলা, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। শুধু ফারাকটা থেকে যায় এই ধর্মকে কেন্দ্র করে। বিদ্যাসাগরের কাছে ধর্মজীবন আলাদা করে কখনো গুরুত্ব পায়নি। তাঁর ধর্মজীবনের ভাবনা জুড়েছিল তাঁর মানবিকতা, সমাজচিন্তা ও সমাজসংস্কারের মধ্যেই। কিন্তু শিবনাথ ছিলেন ধর্মপরায়ণ। তার মূলে সংস্কারমুক্ত যুক্তিবাদী মন থাকলেও, সেটির প্রকাশ ঘটত ধর্মীয় ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমেই।

    হিন্দুধর্ম ছেড়ে যখন ব্রাহ্ম হয়ে উঠলেন, পিতার প্রবল বাধার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, “আপনার সকল আজ্ঞা পালন করিতে রাজি আছি, কিন্তু আমার ধর্মজীবনে হাত দিবেন না”।

    মূর্তিপুজো চিরতরে বন্ধ করতেও বেশ বেগ পেতে হয়েছিল তাঁকে। তাঁর মা প্রায় অবশ হয়ে পড়েন। লাঠি হাতে হরানন্দ তাঁকে মারতে যান এবং প্রায় গায়ের জোর খাটিয়েই তাঁকে ঠাকুরঘরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। তাতেও যখন শিবনাথকে কিছুতেই টলানো যায়নি, হরানন্দ তখন ছেলের সঙ্গে প্রায় সমস্ত সম্পর্ক ত্যাগ করেন। সুদীর্ঘ বছর শিবনাথ শাস্ত্রীর সঙ্গে তাঁর পরিবারের কোনো সম্পর্ক ছিল না। 

    নিজের যুক্তিবোধ, জীবনাদর্শকে ব্রাহ্মধর্মের মধ্যে দিয়ে প্রতিভাত হতে দেখেছিলেন শিবনাথ। ১৮৬৭ সাল পর্যন্ত আদি ব্রাহ্মসমাজ ও দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি তাঁর আকর্ষণ দেখা যায়। কিন্তু সেসময় ব্রাহ্মসমাজের নতুন নেতা কেশবচন্দ্র সেন। তাঁর আদর্শ ও কাজকর্ম শিবনাথের পছন্দ হয়েছিল। ১৮৬৯ সালের ২২শে অগাস্ট তিনি কেশব সেনের দলে যোগ দেন। কিন্তু কখনোই তাঁর ধর্মচিন্তা অযৌক্তিক ছিল না। কথার সঙ্গে কাজের খিলাফ তিনি কোনোদিনই করতেন না। কেশবচন্দ্রের কার্যকলাপ, ব্রাহ্মোপাসনায় অবতারত্বের অবতারণা, বৈষ্ণবসুলভ আচরণ ইত্যাদি নিয়ে যখন প্রশ্ন ও বিরোধ দেখা দিতে থাকে, কোনোভাবেই তা এড়িয়ে চলেননি শিবনাথ। কেশবচন্দ্র সেনের সমালোচনা করে ‘সমদর্শী’ ও ‘সমালোচক’ নামে  দুটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। তার সম্পাদক ছিলেন শিবনাথ শাস্ত্রী স্বয়ং। এরপরে নানান বিবাদ বিসম্বাদের পরেও কেশব সেন যখন হিন্দুমতে নিজের নাবালিকা কন্যার বিবাহ দেন, তখন পাকাপাকিভাবে  দলত্যাগ করেন শিবনাথ শাস্ত্রীসহ বহু মানুষ। এরই ফলশ্রুতিতে  ১৫ই মে ১৮৭৮ সালে সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের প্রতিষ্ঠা। ১৮৭৯ সালে মাঘোৎসবের সময় কর্নওয়ালিস স্ট্রিটের আজকের সাধারণ ব্রাহ্মসমাজের বাড়িটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। 

    শিবনাথ শাস্ত্রী জুড়ে ছিলেন এই পুরো প্রক্রিয়াটির সঙ্গে। তাঁর এই সুচারু যুক্তিবোধ, নিষ্ঠাই তাঁকে প্রণোদিত করেছিল নানান সমাজসংস্কারমূলক কাজে। 

    ঋণ : বিনয় ঘোষের প্রবন্ধ সংগ্রহ
     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @