No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    শিবের গাজন হয় এই পিরের দরগায়

    শিবের গাজন হয় এই পিরের দরগায়

    Story image

    প্রসাদ মান্না
    পিরের দরগায় শিবের গাজন। ‘সোনার পাথরবাটি’ বা ‘কাঁঠালের আমসত্ত্ব’র মত শোনালেও কথাটা কিন্তু সত্য, আর এই সত্য-সুন্দর ঘটনাটি সংঘটিত হয়ে থাকে হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়া থানার বানীবন গ্রামে অবস্থিত পির জঙ্গল বিলাসের দরগায়। ধর্ম নিয়ে, জাতপাত নিয়ে যখন প্রতিদিন রক্ত ঝরছে, প্রাণ ঝরছে, তখন ধর্মান্ধ মানুষের কাছে, পথভ্রষ্ট মানুষের কাছে এই দৃষ্টান্তটি যে একটি আলোকবর্ত্তিকা বিশেষ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই।

    পির জঙ্গল বিলাস, পশ্চিমবঙ্গের পির জগতে এক বিরল প্রকৃতির পির। তাঁর সব কিছুই বিরল প্রকৃতির। সেই বিরল প্রকৃতির অন্যতমটি হ’ল পিরের দরগায় শিবের গাজন। সে কারণে পিরের দরগায় শিবের গাজন কথা দিয়েই পির জঙ্গল বিলাস সাহেবের বিরল প্রকৃতির আবরণ উন্মোচন করা যেতে পারে। বাণীবন গ্রামের পীরপুর পল্লীর প্রধান আকর্ষণ পির আব্বাসউদ্দিন শাহের কবরস্থান। এই কবরস্থান সাধারণের কাছে জঙ্গল বিলাস পিরের কবর নামে পরিচিত। এর গড়ন বাংলার রীতির চারচালা মন্দিরের মত। সাধারণত মসজিদের প্রবেশপথ পূর্ব দিকে হয় কিন্তু এই মসজিদ বা মাজারের প্রবেশ পথ দক্ষিণমুখী। দক্ষিণ দরজার কারিগরিতেও লক্ষ্য করা যায় মন্দিরের ভাস্কর্য শৈলী, পোড়ামাটির অলংকরণ। হিন্দু স্থাপত্যরীতিতে মাজার পশ্চিমবঙ্গের আর কোথাও আছে কিনা জানা নেই। পিরের উৎসব হয়ে হিন্দু বর্ষপঞ্জিকা অনুযায়ী পৌষসংক্রান্তির দিন।

    আরও পড়ুন
    বাংলার পীর – ১০

    হিন্দু বর্ষপঞ্জি অনুসারে চৈত্র মাস শিব ঠাকুরের গাজন উৎসবের মাস। মাসভর গাজন উৎসবের অন্তিমপর্বে অর্থাৎ চৈত্র সংক্রান্তির আগের দিন বা নীল পূজার দিন স্থানীয় শিব ঠাকুরের মূল মন্দিরে বা মন্দির কেন্দ্রিক অন্যান্য শিব-ক্ষেত্রে শিব ঠাকুরের বা দরগায় শিব ঠাকুরের বা নীলকণ্ঠ শিবের ঝাঁপ অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। ঐ দিন বিকালে অথবা সন্ধ্যায় বাণীবনের অন্তর্গত বৃন্দাবনপুর গ্রামের এবং বৃন্দাবনপুর গ্রামের পার্শ্ববর্তী জগৎপুর গ্রামের গাজন দুটি, পির জঙ্গল বিলাসের দরগার এসে সমবেত হয়। প্রথমে পির জঙ্গল বিলাস সাহেবের মাজারের চারপাশের স্থায়ী ব্যবসা প্রতিষ্ঠাগুলিতে গিয়ে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের শ্রীবৃদ্ধি কামনা করে, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মালিককে আশীর্ব্বাদ করে। তারপর ঢাক ও কাঁসির বাদ্য সহকারে ‘বাবা ভোলা মহেশ্বরের চরণের সেবা লাগে’ বলে জঙ্গল বিলাসের মাজার নামক ইমারতটি পরিক্রমা করে। তারপর গাজন দু’টির মূলসন্ন্যাসী সন্ন্যাসধর্মবিহিত অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পিরের মাজারে পিরের উদ্দেশ্যে পূজা নিবেদন করেন। তারপর গাজন দু’টির সমস্ত সন্ন্যাসী পিরের মাজার নামক ইমারতটির পূর্বদিকে পশ্চিমুখী হয়ে কয়েকটি সারিতে দাঁড়িয়ে পড়েন। সম্মুখে থাকেন দুই গাজনের দুই মূল সন্ন্যাসী। এরপর কৌলিক অধিকারসূত্রে বৃন্দাবনপুর গ্রামের ভুঁইয়া পরিবারের কোন এক ব্যক্তি সারিবদ্ধ সন্ন্যাসীগণের সম্মুখে উত্তরমুখে বসে একটি দীর্ঘ ছড়া পাঠ করেন। এই ছড়া পাঠকে ‘দ্বারমুখ’ বলা হয়। ছড়া পাঠের সঙ্গে মূলসন্ন্যাসীদ্বয়কে অনুসরণ করে সারিবদ্ধ সন্ন্যাসীগণ নানা রকম মুদ্রা সহকারে মাথাচালা, বেতনাড়া ও সন্ন্যাসধর্ম অনুসারে শিব পূজায় পালনীয় সব কিছু করে থাকেন।

    পির জঙ্গল বিলাস বাণীবনের গ্রাম দেবতা। মূলত তিনি বাঘের দেবতা বা পির হিসাবে পরিচিত হলেও ভক্ত জনের বিশ্বাসে তিনি সর্ব বিপদের পরিত্রাতা ও সর্ব বিষয়ে রক্ষাকর্তা। সেকারণে আজও গরুর প্রথম দুধ, গাছের প্রথম ফল পিরকে না দিয়ে কেহ ভোগ করেনা। এছাড়া গৃহারম্ভ, গৃহপ্রবেশ, শিশুর মুখে ভাত, ব্যবসা বাণিজ্যের পত্তন, বিদেশ যাত্রা, স্বদেশ প্রত্যাগম ও যে কোন শুভ উদ্যোগের জন্য পির জঙ্গল বিলাসের শিরণি বা পূজা দেওয়া হয়। রোগ নিরাময়ের জন্য হ’ত্যে বা ধরনা দেওয়া, পঙ্গু বা বিকলঙ্গ শিশুর জন্য মাটির ঘোড়া দেওয়া, রুগ্ন শিশুর স্বাস্থ্যকামনায় শোলার সঙ্গে চালের পুঁটুলি বেঁধে পিরের পুণ্য পুকুরে ভাসিয়ে দেওয়া প্রভৃতি আচার অনুষ্ঠানগুলি হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ই পালন করে। বৃহস্পতিবার করে পিরের পুণ্য পুকুরে স্নান ও শিরণি দেওয়া হয়।;

    (ঋণ – জেলা লোকসংস্কৃতি পরিচয় গ্রন্থ ‘হাওড়া’)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @