শিতলাখেত-এক অচেনা কুমায়ুন

উত্তরাখণ্ডে কুমায়ুন পাহাড়ের আলমোরা জেলার ছোট্ট এক গ্রামের নাম শিতলাখেত – রাণীখেতের কাছেই (দূরত্ব ৩৫ কিলোমিটার)।রাণীখেতের নামগৌরবে কিছুটা যেন ঢাকা পড়ে গেছে এই নাম, কিন্তু সৌন্দর্যে এও কম যায় না।চারধারে ঘন জঙ্গল – খালি পাইন আর ধুপী নয়, আছে নাম না জানা নানা রকমের গাছ।সামনে তুষারশুভ্র হিমালয়ের চৌখাম্বা, নন্দাদেবীশৃঙ্গ।আর এখানের উপরি পাওনা নির্জনতা।যারা পর্যটকদের ভিড়ে হারিয়ে যেতে চাননা, নির্জনে হিমালয়কে কাছে পেতে চান, তাদের পক্ষে আদর্শ শিতলাখেত।থাকার জন্য আছে কুমায়ুন মণ্ডল বিকাশ নিগমের পর্যটক নিবাস।তাছাড়া আছে বনবাংলো – পর্যটক নিবাসের পাশেই বৃটিশ আমলের তৈরি বাংলো। এখন দু-একটি বিলাসবহুল রিসর্টও তৈরি হয়েছে।
পর্যটন আবাসের পাশ দিয়েই জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ গিয়েছে স্যাহি দেবীর মন্দিরে, চার কিলোমিটার চড়াই পথ।স্যাহি দেবীকে বলা হয় আলমোড়ার রক্ষাকর্ত্রী। শুনলাম আর কয়েকদিন পরেই নবরাত্রিতে মন্দিরে বসবে মেলা, তখন নাকি পশুবলিও হয়। এমন পথ দেখে ট্রেকিং-এর লোভ সামলাতে পারলাম না, বেড়িয়ে পড়লাম মন্দিরের উদ্দেশ্যে।ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ গিয়েছে, বাঁধানো পথ, তবে স্থানীয় লোকেরা চলার পথ করে নিয়েছে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে। এতে দূরত্ব কমে, কিন্তু খাড়াই বেড়ে যায় অনেক।মাঝে মাঝে আমরাও ধরলাম এই খাড়াই পথ,ওঠার সময়ে হাঁফ ধরে,কিন্তু নামার সময়েই এই পথ সমস্যার,যে কোন সময়ে পদস্খলন হতে পারে।পথে পড়ে গ্রাম,গ্রামের লোকেদের এই ‘ট্রেকিং’এর পথই রোজকার চলার পথ,বাচ্চারা স্কুলেও যাচ্ছে এই পথ ধরে।গ্রাম পেরিয়ে কিছুটা গিয়ে পাহাড়ের চূড়ায় মন্দির।মন্দিরের চারপাশে ঘন জঙ্গলে ঘেরা পাহাড়,দূরে দেখা যায় আলমোড়া শহর – সব মিলিয়ে এক কথায় অপূর্ব। তাড়াতাড়ি ফিরতে মন চায় না। কিন্তু রাস্তার কথা ভেবে সেই ইচ্ছেতে লাগাম পড়াতে হল।পাহাড়ে সন্ধ্যে নামে ঝুপ করে, আর সন্ধ্যের মুখটাই নাকি নেকড়ে বাঘের পছন্দ,অগত্যা।


পরের দিন ঘুরতে ঘুরতে চললাম আরেক জঙ্গলের পথে। সেপ্টেম্বর মাস, গাছে ফুল নেই,কিন্তু নাম না জানা কত ফল ধরে আছে জঙ্গলের গাছে।পাতার উপর আমাদের পায়ে চলার শব্দ আর পাখির ডাক ছাড়া আর কোনও শব্দ নেই,বেশ যেন গা ছমছমে ভাব। রাস্তায় বৃষ্টি বাধ সাধল, বেশিদূর যাওয়া হলনা।কিন্তু বুঝলাম এ জায়গা দুদিন থাকার জন্য নয়, থাকতে হবে অন্তত সাতদিন – আর এভাবে হারিয়ে যেতে হবে জঙ্গলের পথে, গ্রামের পথে।
আরও পড়ুন
উঁকি দিন ভিতরকণিকায়
পর্যটক-আবাসের ম্যানেজারের কাছে শুনলাম – এখান থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে কাতারমল গ্রামে আছে নাকি এক সূর্যমন্দির। গর্ব করে বললেন ‘সবাই সূর্যমন্দির দেখতে কোনারকে যায়,এখানে এই মন্দির অজানাই রয়ে গেছে,কিন্তু সৌন্দর্যে এও কম যায় না’।এর পর তো আর না গিয়ে থাকা যায়না।সকালবেলা প্রাতঃরাশ খেয়েই বেড়িয়ে পরা,প্রায় ৩০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কাতারমল গ্রাম,সেখান থেকে পাহাড়ের গা দিয়ে পা চলার পথ,প্রায় এক কিলোমিটার গিয়ে পৌঁছালাম মন্দিরে।নবম শতাব্দীর প্রাচীন মন্দির – অপূর্ব স্থাপত্য শিল্প।শুনলাম কোনারকের সূর্যমন্দিরের পরেই গুরুত্বপূর্ণ এই মন্দির।মূল মন্দিরকে ঘিরে রয়েছে ৪৪টি ছোট ছোট মন্দির, প্রতিটির সৌন্দর্য দেখে মুগ্ধ হতে হয়।এখন অবশ্য মূল মন্দিরের প্রাচীন বিগ্রহ, কাঠের কারুকার্যসমেত প্রাচীন মন্দিরদ্বার রক্ষণ করা হচ্ছে দিল্লির জাতীয় মিউজিয়ামে।মধ্যযুগের প্রথমদিকে কাত্যুরি বংশ কুমায়ুনে রাজত্ব করতেন।নবম শতাব্দিতে কাত্যুরি রাজা কাটারমল্ল এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।সবুজ পাহাড়ে ঘেরা মন্দির চত্বর থেকে দেখা যায় দূরের আলমোড়া শহর।কুমায়ুনের এক ছোট্ট গ্রামে যে এমন স্থাপত্য শিল্পের নিদর্শন লুকিয়ে আছে তা কে জানত? সার্থক হল আমাদের আসা।এক যাত্রায় হিমালয়,অরণ্য,ইতিহাস, স্থাপত্যশিল্পের সুষমা –ছোট্ট শিতলাখেত উজার করে দিয়েছে আমাদের।

