বাংলায় শিক্ষক বিভ্রাট

রাজা কর্ণেন পশ্যতি। রাজার যুগ ‘গিয়াছে’, গণতন্ত্রে মন্ত্রীই প্রায় সব। মন্ত্রীর সচিব, আমলারাও প্রায় কিছু। ‘প্রায়’ এই কারণে যে, মন্ত্রীর দয়ায় তাঁদের রমরমা। মন্ত্রী যেমন চান ক্ষমতার সিঁড়িতে তাঁদের তেমন অবস্থান। তাঁরা পরামর্শ দেবেন, মন্ত্রী শুনবেন, শোনাটাই তাঁর দেখা, অতত্রব যে কেউ যা কিছু বলবেন আর তিনি শুনবেন তা হবে না। দেখা কম হলেও শোনায় ঘাটতি রাখা চলবে না, প্রমাণ করতেই হবে যে তিনি শোনেন এবং শোনার জন্য ঈশ্বরদত্ত তাঁর দুটো কানের কোনটাই কাটা যায়নি। তবে হ্যাঁ, কার কথা তিনি শুনবেন? এই প্রশ্নটি আসল, মৌলিক। গণতন্ত্রে আজ যে মন্ত্রী কাল সে পটল বেচনেওয়ালা হতে পারে, তাই পোড়খাওয়া, বুদ্ধিমান রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এক গর্তে বল রাখে না, এক ঘাটে জল খায় না। তারা দল ও তার বাইরে বা বিরুদ্ধ-দলকে খুশি রাখে এবং তাতেই গণতন্ত্রের জয় হয়।
আমাদের সৌভাগ্য, আমরা এমন একজন গণতন্ত্রপ্রেমী মন্ত্রী পেয়েছি। তাঁর বিশাল জমিদারি। একটা অংশ শিক্ষাদপ্তর। তিনি শোনেন দুকানে। এক কানের ইজারা নিয়েছে বাজার, অন্য কানের ইজারা ক্ষমতাচ্যুত বামপন্থী শিক্ষা-কূটনীতিকদের।
সেকাল
বামফ্রন্ট ক্ষমতায়, শিক্ষা তাঁদের জমিদারি। দলতন্ত্র গেড়ে বসেছে। তাতে কী- আস্তাবলে ঘোড়া থাকলেই হয় না, চাই যথাযোগ্য চাবুক। চাবুক বাছার জন্য এল বিশেষজ্ঞকুল- শিক্ষা কমিশন। সালটা ১৯৯২। কমিশনের সুপারিশঃ The Commission has gone to the extent of recommending that, in some cases, apart from imposition of penalty, erring teachers should be exposed and widest publicity be given to the details of their violation of the code of conduct.
আচরণ বিধি (Code of Conduct)টি ইউ জি সি-র বানানো। যার প্রধান কথা হল শিক্ষকদের এতো ফাঁকি দেওয়া চলবে না। তাঁদের আরও বেশিদিন শিক্ষাদানে ব্যয় করতে হবে, ১৮০ দিন, আরও বেশি সময়, সপ্তাহে ৪০ ঘন্টা, শিক্ষায়তনে থাকতে হবে ইত্যাদি। দিল্লির পরামর্শ বলে কথা!
যাঁরা এই সব বিধি সুপারিশ করেছিলেন তাঁরা জানেনই না যে দেশের বহু রাজ্যের বহু কলেজে এমন বিধি সরকার চাইলেও কার্যকর করা সম্ভব নয়। সরকার তার কোনও কর্মচারিকেও তার প্রাপ্য ছুটি থেকে তাকে বঞ্চিত না করে ১৯০দিনের বেশি অফিসে আনতে পারে না। বিদ্যালয়গুলিতে তার ওপর আছে পরীক্ষা, ছাত্র সংসদ নির্বাচন, ভর্তি উৎসব, পরীক্ষা হল্লা। এবং নানা স্তরের নির্বাচন, নেতাদের জন্য পুলিশের আসা-যাওয়া ইত্যাদি।
সেদিন কর্তারা বুঝেছিলেন, এভাবে শিক্ষকদের চাপে রাখা যায়, বাগে আনা যায় না। কিন্তু তাতে কী সরকারের মহিমা প্রতিষ্ঠা করার তো ফন্দি চাই। আরও একটা কমিটি হল অধ্যাপক রমেন পোদ্দারের নেতৃত্বে। তাতেও কী আদর্শ আচরণবিধি বাস্তবায়িত হল? না। কোনও পরিবর্তনই কি হয়নি? তা হয়েছে। সে আমলে, যাঁরা নিয়মিত ফাঁকি দিচ্ছিলেন তাঁরা আরও কৌশলী হলেন, আরও একটু সরে এলেন দলের ছাতার তলায়।
একাল
আর এ আমলে? কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বেড়েছে বহু। ছাত্র-ছাত্রী সংখ্যাও। কিন্তু তারা যদি শিখতে চায়? বলে শিক্ষক চাই। তবেই হল। কামারশালে, ঘোড়াশালে, হাতিশালে যে শিক্ষক মেলে না। যা আছে তাতে হয় না। না হোক, একটা বার্তাতো পাঠানো যাবে সমাজে, যে সরকার চেষ্টা করেছে। একটা বার্তাতো পাঠানো যাবে ঈর্ষাকাতর মহলে যে, সরকার শিক্ষকদের ‘টাইট’ দেবার চেষ্টা করেছে; চেষ্টা করেছে ‘রুসা’-র টাকা নয়ছয় বা অপচয় চাপা দেবার। কানে মন্ত্র ঢালার লোক যারা- তারা বলছে এ ভাবেই শিক্ষকদের বাগে আনা সহজ, সমাজকে ধোঁকা দেওয়া সহজ- অতএব, মাভৈঃ।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য অন্য রকম ভাবতে বসেছেন। তিনি চাইছেন শিক্ষকদের অবসরের বয়স বাড়িয়ে সমস্যা সামাল দেবার কথা। তেমন একটা পরামর্শ আমরা তাঁকে দিয়েছিলাম আগে(২০১১সালে), মুখ্যসচিব তখন তাঁকে বোঝালেন- এতে খরচ বাড়বে বহুগুণ। এখনও শোনা যাচ্ছে সেই অজুহাত, শোনা যাচ্ছে তাতে নাকি নবীন প্রজন্মের চাকরির সুযোগ কমবে। এই সবই চরম অসত্য। মুখ্যমন্ত্রীকে বিপথে চালনার চেষ্টা।
তখন লিখেছিলাম (বৈশাখ ১৪০৩, চতুরঙ্গ), যে মাটির ওপর কর্তারা দাঁড়িয়ে সে মাটিটাই ভীষণ কাঁপছে। শিক্ষা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল ও শ্রীবৃদ্ধি ঘটাতে পারে ছাত্র, শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মীর পক্ষপাতহীন যৌথ উদ্যোগ, আইনের চাবুক নয়।
তবু ওদের ভরসায় চাবুক হাতে রাখতে চান? তা রাখুন। তবে, দয়া করে খেয়াল রাখুন, ওরা ঝাঁকের কৈ, ঝাঁকে মিশে যাবে। আর ওদের ভরসাতে থেকে ওদের দলবল ডুবেছে, ‘শিক্ষা’ ডুবেছে। আবার সেদিন আসছে না-তো? তেমন দিন এলে চাবুকটা আপনার বা আপনার একালের বন্ধুদের হাতেই থাকবে তো!