পলিফ্লাওয়ার থেকে ‘ব্যানার্জিস পালং-- মানবজমিনেও সোনা ফলাতেন প্রফুল্লচন্দ্রের ছাত্র শিবপ্রসাদ

মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল। সুঠাম দেহখানি বয়সের ভারে ঝুঁকে পড়েনি। হাঁটু অবধি মোটা কাপড় আর মুখে শিশুর মতো হাসি। ক্ষেতের আলপথ বেয়ে সাইকেল চালাচ্ছেন এক আশ্চর্য মানুষ। আজ থেকে ক’দশক আগে বোড়াল গ্রামে দেখা যেত তাঁকে। আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের যোগ্য ছাত্র -- শিবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়।
জন্মেছিলেন অধুনা বাংলাদেশের গোবিন্দপুর গ্রামে। মাতুলালয়ে। পরে পড়াশুনার জন্য চলে এসেছিলেন শ্রীপুর। এই শ্রীপুর গ্রাম ছিল আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের পৈতৃক বাড়ির কাছেই। ছোট্ট শিবপ্রসাদ পড়ে থাকতেন গাঁয়ের কবিরাজ মশাইয়ের বাড়ি। চড়ক-শুশ্রুতের বই উল্টোতে উল্টোতে, চ্যবনপ্রাশ বাঁটতে বাঁটতে কেটে যায় ছেলেবেলা। তবে, পরিবারে অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। ‘বামুনের ছেলে’ তাই বাধ্য হয়েই তুলে নিয়েছিল লাঙল। তারপর একদিন হঠাৎ করেই সুঠাম-ডানপিটে শিবপ্রসাদ নজরে পড়ে গিয়েছিলেন আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের। তিনি গ্রামের ছেলেদের সঙ্গে মিশতেন অবাধে। বিশেষত ‘স্বাস্থ্যহীন-অর্থহীন –খিদমতগার’ বাঙালি তরুণদের মধ্যে যদি এক একটি ‘রতনে’র সন্ধান পাওয়া যায় তাহলে তো কথাই নেই। তেমনই এক রত্ন ছিলেন শিবপ্রসাদ।
১৯২৩ সালে এক মামলায় বোড়াল গ্রামের পৈতৃক সম্পত্তি ফিরে পান শিবপ্রসাদরা। তার দু’বছর পরেই ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন তিনি। ততদিনে তাঁরা বোড়াল গ্রামে পাকাপাকিভাবে বসবাস করছেন। কিন্ত ‘গুরু’-র সঙ্গে যোগাযোগ ছিল অক্ষুণ্ণ। একদিন দেখা হতেই, আচার্য বললেন, “চাষ কর”। প্রফুল্লচন্দ্র জানতেন, মেকলের মানসপুত্র, বাঙালি জাতি ভুলেছে মাটিকে। তাই নতুন ভারতবর্ষের প্রাক্কালে, তিনি স্বপ্ন দেখেছিলেন এক স্বনির্ভর বাঙালি সমাজের। যার কাণ্ডারি হবে তাঁর হাতে তৈরি ছেলের দল...
শিবপ্রসাদ শুরু করলেন তাঁর ‘চাষ-বাস’। তাঁর ‘খেলাঘর’ হয়ে উঠল বোড়াল-কৃষিখামার। বিভিন্ন বীজ নিয়ে গবেষণা করতে করতে একদিন বেরোল, ‘ব্যানার্জিস পালং’। মাটির নিচের অংশে বিট আর উপরের অংশে পালংশাক। ওজন প্রায় ৮-১০ কিলোগ্রাম ! অথচ খেতে সুস্বাদু। এর ক’দিন পরেই ব্রকোলি আর ফুলকপির শুভ বিবাহের ফসল ‘পলিফ্লাওয়ার’ ! অনেকটা প্রফেসর শঙ্কুর মতো শোনাচ্ছে না ? কৃষিখামারে ছড়িয়ে চব্বিশ রকমের নতুন প্রজাতির গোলাপ। খেয়ালখুশিতে শিবপ্রসাদ মিলিয়ে চলছেন আম-কাঁঠাল-পেয়ারা-বাতাবিলেবু।
কিন্তু দেশের কৃষিক্ষেত্র ধুঁকছে তখন। চাষিভাইদের সঙ্গে মিলে ‘শিববাবু’ ছোটেন সরকারি দপ্তরে দপ্তরে। বীজ-সারের আশায়। ইতিমধ্যেই তৈরি করেছেন কৃষক সমিতি। তাঁর উদ্যোগেই অনুষ্ঠিত হয়েছে কৃষিমেলা। সাধারণ মানুষ যদি একটু তাকায় মাটির দিকে। কিন্তু ফলন আশানুরূপ হচ্ছে না। সবার মাথায় হাত। অবশেষে বহু পরীক্ষানিরীক্ষার পর বেরোল ‘গোলাসার’ বা ‘ফোলিয়ার ফিড’। আবিষ্কারকের নাম শিবপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় । গোলাসারে তুলনায় জল লাগে খুব কম। সহজেই ফলে ফসল। চাষিভাইদের মুখে ধন্য ধন্য পড়ে যায়। দুহাত তুলে আশীর্বাদ জানায় তাদের সহযোদ্ধাকে।
এদিকে তিনি ছিলেন নির্বিচারে রাসায়নিক সার প্রয়োগের ঘোর বিরোধী। দূরদর্শী মানুষটি বুঝতে পেরেছিলেন,কীটনাশকের ফলে মাটির কী পরিমাণ ক্ষতি হবে। তাঁর আবিষ্কার, গোলাসারের মূলে ছিল গোবর, এবং প্রকৃতি থেকে ধার করা অন্যান্য কিছু উপাদান।
কিন্তু শিবপ্রসাদ কি শুধুই একজন আপনভোলা বিজ্ঞানী ? তাঁর খামারে দাঙ্গার থেকে আশ্রয় পেয়েছিল বহু সংখ্যালঘু মানুষ। ১৯৪৬ সালে, সাম্প্রদায়িক হানাহানির বাতাবরণ-এ, কলকাতার যাদবপুরে গঠিত হল ‘পিস কমিটি’। তার অন্যতম উদ্যোক্তার নাম বলাই বাহুল্য। ছোটোবেলায় পৈতে ছেঁড়া শিবপ্রসাদ না মানতেন জাত- না মানতেন ধর্ম। তাঁর মতে, “ঈশ্বর নয়, প্রকৃতি ও মানুষই হলো প্রথম ও শেষ কথা।”
আমুদে-আড্ডাবাজ লোক। হলঘর মাতিয়ে রাখতেন। কিন্ত চূড়ান্ত প্রচারবিমুখ। নিজের কাজ সমন্ধে অহংকারের লেশমাত্র নেই। জীবদ্দশায় স্বীকৃতি মিলেছে কিছু। বিধানচন্দ্র কৃষিবিদ্যালয় তাঁকে দিয়েছিল সাম্মানিক ডি-এস-সি। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়, নানা ফিচারে পাওয়া যাবে টুকরো টুকরো কিছু ছবি। প্রচুর বড়ো বড়ো মানুষ ঘুরে গিয়েছেন তাঁর কৃষিখামার। ফাঁকে ফাঁকে চুরি গিয়েছে কাগজপত্র-গোলাপের চারা। কেউ কেউ তাঁর গবেষণার কাগজ থেকে থিসিস নামিয়ে বিখ্যাত হয়ে গিয়েছেন রাতারাতি। শিবপ্রসাদ উচ্চবাচ্য করেননি।
শেষবয়সে, কেউ তাঁর ভাঙাচোরা কুটিরে গেলে খুশিতে পাগল হয়ে যেতেন বৃদ্ধ। কাঁপা কাঁপা হাতে কেটে আনা বাগানের সবজি, উপহার দিতেন অতিথিকে... শুধু মাটিতে নয়, মানবজমিনেও সোনা ফলাতেন শিবপ্রসাদ। আমরা ক’জনই বা তাঁর খবর রেখেছি !
সূত্র : ‘তিন অবহেলিত জ্যোতিষ্ক’- রণতোষ চক্রবর্তী