উত্তর কলকাতার সিমলা পাড়ায় কাটানো মির্জা গালিবের দিন-রাত

পোর্ট্রেট: অলোক লাল
বিডন স্ট্রিট (beadon street) কলকাতার ব্যস্ত রাস্তা। সেখান থেকে বেথুন স্কুলের (bethune school) পিছনের বাঁদিকে যে ছোট্ট রাস্তাটা ঘুরে গেছে, সেই পথ আজ পরিচিত বেথুন রো নামে। সেটা গিয়ে মিশেছে আবার রামদুলাল সরকার স্ট্রিটে। এই অঞ্চলটি আজও সিমলে পাড়া নামেই পরিচিত, যেখানে পূর্বে ছিল সিমলা বাজার (Simla)। এখানে আজও মিশে আছে মুঘল সালতানতের মহামহিম এক কবির করুণ কাহিনি। যে কাহিনি পড়তে পারা যায় কেবলমাত্র তাঁর শায়েরমালার ‘সফর-এ কলকাত্তাহ’-তে (safar-e kolkata)। সেখানে তিনি জানাচ্ছেন সিমলা বাজারের কাছে ১৩৩ নম্বর হাভেলিতে তাঁর বসবাসের কথা। লিখে রাখছেন কিছুটা দূরের চিৎপুর (Chitpur) বাজারের কথা। বলছেন কলকাতার মতো এমন মন জয় করা জমি তামাম দুনিয়া আর কোথাও নেই। কবির নাম মির্জা আসাদুল্লাহ বেগ খান। তাঁর মন মাতানো শায়ের শুনে দিল্লির মুঘল বাদশাহ দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ্ জাফর তাঁকে দাবির-উল-মুলুক আর নজম-উদ-দউল্লা উপাধি দিয়ে সম্মান জানিয়েছেন। উর্দু, পার্শি ভাষার কবি আসাদুল্লা বেগ খান। মানবিক যন্ত্রণা আর ঈশ্বর চেতনার আবেগের কোলাজে তাঁর কাব্য যে অভিনবত্ব পেয়েছে, তা ইসলামি কাব্যকে এক লহমায় এগিয়ে দিয়েছে বহুদূর। দিল্লির বাদশাহ নিজেও একজন মহান কবি। আসাদুল্লা বেগকে ছাড়া তাঁর সময় কাটে না। বাদশার সঙ্গে তাল মিলিয়ে লেখার পাশাপাশি চলে বিকেলবেলার ঘুড়ি ওড়ানো।
গালিব জানাচ্ছেন সিমলা বাজারের কাছে ১৩৩ নম্বর হাভেলিতে তাঁর বসবাসের কথা। লিখে রাখছেন কিছুটা দূরের চিৎপুর বাজারের কথা। বলছেন কলকাতার মতো এমন মন জয় করা জমি তামাম দুনিয়া আর কোথাও নেই।
কিন্তু সেটা মুঘল আমলের অস্তমিত সময়কাল। বাদশাহ তখন ইংরেজ বাহাদুরের পেনশন ভোগী। শুধু তাই নয়, দিল্লি আর আশেপাশের নামমাত্র কয়েকটি জায়গা ছাড়া তাঁর শাসনের দৌড় সীমা বেশি বড়ো নয়। তথাপি এই বাদশাহ গুণীজনের কদর করতে জানেন। কিন্তু ধীরে ধীরে বাদশাহ-র প্রতি মন বিষিয়ে উঠছে ইংরেজদের। কিছু লোকজনের আনাগোনা তারা ভালো চোখে নিচ্ছেন না। পাশাপাশি তাঁর দরবারের কবিকেও তারা সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলেন। ইংরেজ বিরোধী ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর সঙ্গেই যেন এঁর বেশি প্রকার দহরম মহরম। হঠাৎ একদিন ফরমান পেলেন বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগের কারণে তাঁর পেনশন বন্ধ করে দেওয়া হবে। স্বয়ং নবাবও কিছু করতে পারলেন না।
নিজের ‘সফর-এ কলকাত্তাহ’-তে লিখছেন কোঠির উল্টো পাড়ে আছে একটা গোল তালাও আর সামনে শিমলা বাজার। আজকের মানচিত্র বলে, এই গোল তালাওটাই হল হেদুয়ার আজাদ হিন্দ বাগের সাঁতার কাটার পুকুরটি।
১৮২৬ সাল। দিল্লি থেকে কখনও পায়ে হেঁটে কখনও ঘোড়ায় চড়ে আবার খানিকটা বজরায় বা ডিঙি নৌকোয় তিনি পাড়ি দিলেন কলকাতার পথে। কারণ স্বয়ং বড়োলাট যদি একটু সদয় হন তাহলেই একমাত্র তাঁর পেনশন মিলতে পারে। কলকাতায় এসে সিমলা বাজার অঞ্চলের ১৩৩ নম্বর বাড়িতে উঠলেন। এই নম্বরটি আজও অটুট আছে, শুধু কোঠির চেহারাটুকু গিয়েছে পালটে। নিজের ‘সফর-এ কলকাত্তাহ’-তে লিখছেন কোঠির উল্টো পাড়ে আছে একটা গোল তালাও আর সামনে শিমলা বাজার। আজকের মানচিত্র বলে, এই গোল তালাওটাই হল হেদুয়ার আজাদ হিন্দ বাগের সাঁতার কাটার পুকুরটি।
আরও পড়ুন: রঘু রাই-এর চোখে যেভাবে স্থির হয়ে আছে কলকাতা
এইভাবে চলল তাঁর কলকাতার প্রতি প্রেম, তার সঙ্গে লাট বাহাদুরের কাছে করুণ প্রার্থনা। সংসার চলে না। এরকম উচ্চ পদমর্যাদার কবিকে উত্তর কলকাতা (North Kolkata) থেকে নাখোদা মসজিদের (Nakhoda Mosque) কাছে নিয়ে যেতে চাইলে তিনি যেতেও চান না। হিন্দু ধর্মের প্রতি তাঁর গভীর প্রীতি। হিন্দু পাড়াতে থাকতেই তাঁর আনন্দ। হিন্দু পাড়ার মানুষেরাও তাঁকে বাবা বলে সম্মান জানায়। এমন বেদনাকাতর কবির জন্যে তাদেরও চোখ বেয়ে পানি গড়ায়। সেদিনের শিমলে পাড়ায় ছোটো-বড়ো সকলের জীবনচর্যাই যেন গড়ে উঠতে লাগল এক বিরহকাতর শায়ের জগতের বাদশাহকে নিয়ে। আজ আর সে অঞ্চলের কেউ তাঁকে মনে রাখেনি। হয়তো বা জানেও না। কিন্তু তাঁর কাব্যে ধরা রইল সিমলে পাড়ার মানুষের তাঁর প্রতি দরদের কাহিনি। ধরা রইল পুরোনো কলকাতা। পেনশন তো দূরে থাক, দেখাও মেলেনি লাট বাহাদুরের। তাই কলকাতা থেকে ইংরেজের প্রতারণা নিয়ে শূন্য হাতে ফিরলেও উত্তর কলকাতার এই অঞ্চলের মানুষদের ভালোবাসা নিয়ে ফিরেছেন হৃদয় পূর্ণ করে। আজ সেই হতভাগ্য কবিকে লোকে চেনে মির্জা গালিব নামে।