হেমন্তের অরণ্যের সেই পোস্টম্যান

একজন স্রষ্টাকে মানুষ কিসে চেনে? শুধুই কি তাঁর সৃষ্টি দিয়ে? যেভাবে রবীন্দ্রনাথকে চিনেছি বা জীবনানন্দকে, সেভাবেই কি চিনেছিলাম শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে? আমরা যখন কৈশোর আর যৌবনের সন্ধিক্ষণে, সে অস্বস্তি আর অস্থিরতার বয়সে আমাদের বহু একা এবং মন খারাপের দুপুরে যতটা শক্তি-সুনীল শক্ত করে আমাদের হাত ধরেছিলেন, ততটা জায়গা জুড়ে কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বা জীবনানন্দও ছিলেন না। রবীন্দ্রনাথ ছিলেন গানে, জীবনানন্দ ছিলেন রোম্যান্টিকতার এক অত্যাশ্চর্য গোধূলি -নির্মাণে আর শক্তি-সুনীল? আমাদের অদেখা অচেনা অথচ কী ভীষণ চেনা নিত্যদিনের বোহেমিয়ান এবং নিয়ম ভাঙার নিয়ম শেখানো গোপন প্রেমিক হয়ে।
এই সব কবিতা পড়তে পড়তে আমাদের চেতনার ভুবন ক্রমাগত রং বদলাল, পেঁয়াজের খোসা ছাড়ানোর মতো করে আমরা কিছুটা যুক্তি এবং কিছুটা অর্বাচীনতায় এই সব কবিতার ময়না তদন্ত করে যে যার মতো ব্যাখ্যা দিতে শিখলাম এবং যখন ভাবলাম এই তো বেশ বুঝে যাচ্ছি, তখনই নতুন এবং নতুনতর কবিতা আমাদের আদ্যন্ত এলোমেলো করে দিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে মজা দেখতে লাগল। আমরা কবিতার ভুলভুলাইয়ায় ঘুরপাক খাই, আবার অন্ধকারে কখন দেখি পৌঁছে গেছে আলো।
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাট চুকল। কলকাতার পাট চুকল, কবিতার পাট এবং পাঠ কোনোটাই চুকল না। আমার সংসারে এই দু-জন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে নিলেন।
সুনীলকে চাক্ষুষ দেখেছি পরবর্তী জীবনে, কথা বলেছি। কিন্তু শক্তিকে প্রত্যক্ষ করিনি। কথাটা সত্যি, তবু বলতে গিয়ে মনে হল অনৃতভাষণ হল। কবিতায় দুজনকে একইভাবে ছুঁয়ে থাকলেও দৃশ্যমান এবং অদৃশ্য উপস্থিতির দর কষাকষি করলে শক্তি খানিক এগিয়ে থাকবেন।
পূর্বাঙ্গনায় যতবার যাই, ওই গাছের কেয়ারী পেরিয়ে ডাকঘন্টি বাজাই আর দরজা খুলে যায়। ভেতরে পা দিলে বোঝা যায়, এ বাড়ির আনাচে কানাচে একজন মানুষের কী প্রবল উপস্থিতি ! যেদিকে তাকাই, মনে হয় ...এক্ষুনি দেখতে পাব। অথচ এমনটা মনে হবার কথা ছিল না কিন্তু ! কারণ শক্তি তো সংসারের নিয়ম না মানা এক সংসারী মানুষ। কবিতার জন্য যিনি সব কিছু লন্ডভন্ড করে চলে যেতে পারেন কাকভোরে অথবা মধ্যরাত্রে, কাউকে কিছু না বলে যখন তখন যেমনভাবে খুশি জীবনযাপনের হিম্মত রাখেন, শব্দ হাতে এলেই তা খরচা করে ফেলতে সিদ্ধহস্ত। তাও সে মানুষটি কী যাদুমন্ত্রবলে রয়ে গেছেন চৌকাঠের এপারে এবং ওপারে ! ইচ্ছেসুখে চলে যান, ইচ্ছেসুখে ফিরে আসেন। বাতাসের মতো। তাঁর শব্দকে, তাঁর ছন্দকে, তাঁর জীবন এবং যাপনকে আর পাঁচটা চেনা নিয়মের নিগড়ে বাঁধা অর্থহীন। তাই দরজা জানলা খোলাই থাকে। এখনও। একইভাবে। কবির জন্য। কবিতার জন্য। বসত ঘরের। মনের ঘরেরও। তিনি বলেছিলেন, “ও চিরপ্রণম্য অগ্নি , আমাকে পোড়াও। ” আর চেয়েছিলেন, সবশেষে যেন চোখ দুটি যায়...কারণ তাদের দেখার কিছু বাকি।
কবিতার দিগন্ত তো সত্যিই দেখা যায় না ! আমৃত্যু।
"শুদ্ধসীমা থেকে যাত্রা কবিতার সর্বাঙ্গে, যেমন
মধুর বিহ্বল পায়ে পিঁপড়ে পড়ে ছড়িয়ে সুধায় --
বিষে ও নির্বিষে, আমি যাই, যেতে -যেতে বাধা পাই
আনন্দে পশ্চিমে চলি, টানে পূর্ব উৎকৃষ্ট ক্ষুধায়।
প্রসঙ্গত কোনো দিক, কোনো তৃষ্ণা-বিতৃষ্ণার মোহে
আমাকে যেতেই হবে, পূর্ণাপূর্ণ, প্রাণে ও অপ্রাণে
ক্ষমতার কূট যদি শাস্তি দিত, হতাম অক্ষম
জড় ও জীবিত পিণ্ড, নৌকা ভাঙা ঘাটের সন্ধানে।
কোথা ঘাট? জলের প্রচ্ছদে কোথা পরিপাটি শুকনো অন্ধকার
ভ্রূ-র ! কোথা, কই কাজ কাজলের? ও মর্ত্যলোকের --
ইতস্তত পড়ে-থাকা মানুষের শ্মশানের ছবি
ওঁ কৃষ্ণ, কৃষ্ণ...লেখে সমুৎপন্ন সুস্থ এক কবি
রক্তে, টক চক্ষুজলে ; আর করে আমাকে উদ্ধার
শুদ্ধসীমা থেকে যাত্রা করি আমি সর্বাঙ্গে তোমার। "
"বুকে বালিশ চেপে লেখা আমার অভ্যেস। নিজেকে উপুড় করে কলসী- কুঁজোর মতো। উপুড় করলে ওদের থেকে যেমন জল পড়ে মেঝেয় ছড়ায়, তেমনিই আমার কলম থেকে কাগজের ওপর কালো -নীল অক্ষর। জানলা দরজা বন্ধ করতে হত না । একধরনের অন্ধকার আমায় নিজের মধ্যে ডুবতে সাহায্য করে সবসময়। আলোর মধ্যে আমার অস্বস্তি হয়। একটু কালো করে নিতে হয়। "
এই অন্ধকার নিজের ভেতরের আলো খোঁজার। যেদিন এই অন্ধকারের কাছে যেতে পারা যায়, সেদিন গন্তব্যে পৌঁছে দেখা যায়..সেখানে অনেক আগেই তো কখন পৌঁছে গেছে আলো। সে আলো মননের।সে আলো বর্ণমালার।
২৫ শে নভেম্বর , ২০১৩। শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের জন্মদিন পালনের উৎসব ছিল। বেলেঘাটায় পূর্বাঙ্গনে কবির আবাসে একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠান ছিল সেই সন্ধেতে। কলকাতায় আসি। যখন আসি, ঠিক তখন বুঝি না..কেন আসি, কিসের জন্য আসি। যখন ফিরে যাই, তখন কষ্টের ভাঙচুর চিনিয়ে দেয় অবচেতনে আসার আকুতিকে। কখনো কবিতার জন্য, কখনো নাটকের জন্য, কখনো গানের জন্য। তেমনই সেই সন্ধেবেলাটা ছিল কবিতা, তোমার জন্য। না, শুধু কবিতার জন্যই নয়, শক্তি তো গদ্যও লিখেছেন নেহাত কম নয়। সেই সন্ধেটা বরং সেই সব চেনা শব্দের জন্য রাখা ছিল, যেসব শব্দকে মহার্ঘ রেশমের বালাপোষের মতো গায়ে জড়িয়ে আমরা বড় হয়ে উঠেছিলাম।
যে ক'বার গেছি, প্রতিবারই কিন্তু একই অনুভূতি। পূর্বাঙ্গনের বাড়িটি দেখলেই মন ভালো হয়ে যায়। ছিমছাম, সবুজ গাছগাছালি। আর .. বৈঠকখানা ঘরের চৌকাঠ থেকে শোবার ঘরের আনাচ কানাচ পর্যন্ত শক্তি মিশে আছেন। সর্বত্র। শক্তি আছেন কী প্রবল নিরুচ্চার অথচ বাঙ্ময় উপস্থিতি নিয়ে। আলোকচিত্রে, পেন্সিল স্কেচে, এমনকি নেপথ্যে অনন্ত জিজ্ঞাসায় .."অবনী , বাড়ি আছো? "
সবাই টুকিটাকি কথা বলছিলেন সেই সন্ধেবেলায়। মীনাক্ষী মাসীমাও। আমার বান্ধবী ... শক্তিকন্যা তিতি গান গাইছিল..মুখটি ছিল নীচু, দক্ষিণী তাঁতের শাড়িটি পরিপাটি বিছিয়েছিল লাল কার্পেটে। ও গাইছিল, "আমার হিয়ার মাঝে লুকিয়েছিলে, দেখতে আমি পাইনি, তোমায় দেখতে আমি পাইনি। বাহির পানে চোখ মেলেছি, বাহির পানে..আমার হৃদয় পানে চাইনি..."। আমি যখন একটি পত্রিকার জন্য একবার তিতির সঙ্গে শক্তিবিষয়ক কথোপকথন "অন্য কুয়োতলা" লিখেছিলাম, তখনও ..আর সেই সন্ধেবেলা তিতি যখন গানে..তখনও...আমার বুকের ভেতরটা কেমন চলকে উঠেছিল।
"হাঁটিতে শিখেছি সেই কবে থেকে, এখনো তোমার
হাতখানি ধরা চাই, বুঝে নেওয়া চাই -বুঝিব না
কিছুই ব্যতীত তুমি, এ কি অবলম্বনের ঘোর
এ কি পিতৃপরিচয়? "
এই অসহায় অবলম্বনের ঘোরে তিতি গাইছিল আর মাসীমা... তখন পশ্চাদপটে কিছু পংক্তি ছিল ... কিছু প্রিয় কথা, কিছু চেনা কথা বাজছিল ...
"তোমার হাত যে ধরেইছিলাম তাই পারিনি জানতে
এই দেশে বসতি করে শান্তি শান্তি শান্তি
তোমার হাত যে ধরেইছিলাম তাই পারিনি জানতে
সফলতার দীর্ঘ সিঁড়ি, তার নীচে ভুল-ভ্রান্তি
কিছুই জানতে পারিনি আজ, কাল যা কিছু আনতে
তার মাঝে কি থাকত মিশে সেই আমাদের ক্লান্তির
দু-জন দু-হাত জড়িয়ে থাকা --সেই আমাদের শান্তি?
তোমার হাত যে ধরেইছিলাম তাই পারিনি জানতে। "
গান ছিল, কবিতা ছিল। আর শক্তি ছিলেন। সেই শক্তি...যিনি বলেছিলেন,
"শব্দ হাতে পেলেই আমি খরচা করে ফেলি
যেন আপন পোড়াকপাল, যেন মুখঢাকানি চেলি
ছলাৎছলো দিনের শেষে গান যদি না মেলে
শব্দ হাতে পেলেই আমি খরচা করে ফেলি। "
এই শব্দ বড় মোহনমায়ার বস্তু। এই শব্দ এক আশ্চর্য কুবেরের ভাণ্ডার। যার চাবিকাঠি ছিল শক্তির কাছে সেই প্রথম থেকেই... শক্তির কাছে শব্দ এক অনন্ত আকাশ-ভ্রমণ...
"শব্দ, মানে দুইদিকে তার মুখটি থাকে বিশ্ব জুড়ে
রামধনুকের মতন রঙিন সার্বজনীন পন্থ খুঁড়ে ..."
কবিতা লেখা বড় কঠিন কাজ। কারণ বাকসংযম না থাকলে কবিতা লেখা যায় না। অন্তত ভালো কবিতা লেখা যায় না। কবি বলবেন যা, অব্যক্ত থাকবে অনেক বেশি। এক একজন পাঠকের কাছে একই কবিতা এক এক অভিঘাত নিয়ে আসে। ধ্বনির অভিঘাত, শব্দ চয়নের অভিঘাত, ভাবনার অভিঘাত। কিছু বোধগম্য হয়, কিছু বা থাকে আলো-আঁধারিতে। মোট কথা, এই সব মিলিয়েই কবিতা "আপন কবিতা" হয়ে ওঠে।
শক্তি অবাধে খেলা করেছেন শব্দ নিয়ে, শব্দের অন্তর্গত সঙ্কেতমালা নিয়ে, ছন্দ নিয়ে এবং ছন্দ ভাঙা নিয়ে। এই শব্দমালা উন্মোচিত করে এক আনন্দদুয়ার। যা পার হলেই সেই অতুল বৈভব ..যে দীপ্তিতে শক্তির "ঐশ্বর্যজটিল মন" বারবার জন্ম দিয়ে যায় বুকের মধ্যে মেঘের আর বুকের মধ্যে বৃষ্টির...
"বুকের মধ্যে বৃষ্টি নামে, নৌকা টলোমলো
কুল ছেড়ে আজ অকূলে যাই এমনও সম্বল
নেই নিকটে -- হয়ত ছিলো বৃষ্টি আসার আগে
চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, তাই কি মনে জাগে
পোড়োবাড়ির স্মৃতি? আমার স্বপ্নে মেশা দিনও?
চলচ্ছক্তিহীন হয়েছি, চলচ্ছক্তিহীন। ''
কবির গদ্য অন্যরকম গদ্য। কবির গদ্য সূক্ষ্মভাবে জানান দিয়ে যায় গদ্যে কবিতা লুকিয়ে আছে...যা পড়লে ..."বুকের ভেতর মেঘ ডেকে ওঠে গুড়গুড় শব্দে। বিদ্যুৎচমক আছে। বাজ আছে। শরীরের এখানে ওখানে আছে চিড়িক দেওয়া। সর্বাঙ্গ হিম পাথর পরক্ষণেই। আবার পরক্ষণেই পাথরে তাপ উত্তাপ। পাথরে আগুন।"
শক্তির গদ্যও তো তেমনই। তবু শক্তি নিজের গদ্য নিয়ে তেমন যত্নবান ছিলেন না। কারণ হিসেবে বলেছিলেন, "মনে মনে বিনয়ী আমি কখনোই নই। স্বেচ্ছাচারীর যে ধরনের অহঙ্কার তা আমার পুরোমাত্রায় আছে। জানি, ইচ্ছে করলে করতে পারি। কিন্তু পারব না। ইচ্ছে করব না। উপত্যকায় পৌঁছতে বনপাহাড়ি সুঁড়িপথ আমার সঙ্গে আছে। তা হল পদ্য। তাকে আমার জানলার নীচে পাড়ের দড়ি দিয়ে বেঁধে রেখেছি। লোহা-ইস্পাত-নারকোল কাতায় নয়। সে বড় কোমল। ''
কবিতা শক্তির কাছে প্রতিমার মতো। ছন্দ অছন্দের ঘামতেলে চকচকে মুখ, শব্দের গয়নায় ঝলমলে, ভাবনার রেশম শাড়িটি সর্বাঙ্গে জড়িয়ে চেতনার রক্ত-অলক্তক আঁকা পায়ে সে কবির অন্দরমহলে আসে, ঘরকন্না সেরে বারদুয়ার দিয়ে পায়ের নূপুরজোড়াতে ঝিনিক তুলে বেরিয়ে যায়। শক্তি কলম বন্ধ করে তৃপ্তির শ্বাস ফেলেন। অধরা এভাবেই ধরা দেয়। ওই যে..অন্ধকার পেরিয়ে হাত ধরে আলোয় নিয়ে যায়। অন্তর থেকে বাহিরে।
আসলে অনুষ্ঠান চলছিল তো সেদিন ! অনেকে অনেক কথা বলছিলেন। অনেকে অনেক কিছু ভাবছিলেন। আমিও তো ভাবছিলাম। কবির কথা। যিনি বলেছিলেন, "ঝোলা কাঁধে বউ ছেলে নিয়ে সুখে থেকে কবিতা লেখা যায় না। '' অর্থাৎ কবিতা লিখতে হয় এক অবোধ্য তাগিদ থেকে, এক অন্ধকার সুড়ঙ্গে আলোর জন্য ওলটপালট খেতে খেতে। কবিতা "মায়াবী এই আলোয় ওড়ায় মায়া ভাঙার ফানুস"।
আমি সেই আপস না করা মানুষটিকে দেখছিলাম। শুনছিলাম সেই অস্থির পদচারণার শব্দ। শুনছিলাম সেই গান একা। সমুদ্রতীরে। "বসে আছি হে, কবে শুনিব তোমার বাণী ..."
আর জন্মদিনে অনেক ফুলে আর গানে ..আনন্দ -ভৈরবীর তানে যে মানুষটি অস্ফুটে বলছিলেন,
" সবার কাছে
একটি নতুন বিদায় নেবার বার্তা আছে...
যাই?
চঞ্চলতার আড়ালে তার সবখানি না পাই '
পাচ্ছি কিছু।
আমার মতো নম্র শামুক, ঐখানে তো মুখটি নীচু !
যেন অথৈ জলের ভারী
আমার দু:খ-সুখের তরী, ঐরাবতের ও কাণ্ডারী...
যাই?
চঞ্চলতার আড়ালে তার সবখানি না পাই,
পাচ্ছি কিছু।
আমার মতো নম্র শামুক, ঐখানে তো মুখটি নীচু !