No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ‘নিজের জীবনটাকেই শক্তি বাজি ফেলল’

    ‘নিজের জীবনটাকেই শক্তি বাজি ফেলল’

    Story image

    সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় 
    শক্তির সত্যি ষাট বছর বয়েস হয়ে গেল? বছর গুনে গেলে বোধহয় মিলবে, কিন্তু সেই ভাবে তো সকলের বয়েস বাড়ে না! পৃথিবীর শক্তি চট্টোপাধ্যায়দের বয়েস বছরের হিসেব কষে হয় না। শক্তির মধ্যে এখনো যে একটা দুরন্ত শিশু রয়ে গেছে।

    বুদ্ধদেব বসু এক জায়গায় বলেছিলেন যে সদ্য কৈশোর উত্তীর্ণ বয়েসে ছুটির দুপুর কাটাবার জন্য অলস ভাবে যে কিছু কিছু কবিতা লিখেছি, পরবর্তী পণ্ডিত গবেষকরা যে সেই সব কবিতা নিয়ে মাথা ঘামাবেন, তা কে জানতো! শক্তিও মাঝে মাঝেই বলতো, ভাগ্যিস কবিতা লিখেছিলুম, তাই তো এত কাণ্ড হলো! মন-মন কাজে এমনিই তো কবিতা লিখতে শুরু করেছিলুম, ভবিষ্যতে কী হবে, কিছুই তো ভাবিনি!

    সত্যিই তাই, শুরু হয়েছিল প্রায় খেলাচ্ছলে। অনেকে বলে, কবিতা লিখতে হয় বুকের রক্ত দিয়ে, কিংবা কবিতা লিখে সমাজটা বদলে দিতে হবে, কিংবা কবিতা লিখে যেন সাত পুরুষকে ধন্য করে দেওয়া হয়েছে, তখন আমার গোপনে হাসি পায়। আমরা তো সেরকম কিছুই ভাবিনি। আমরা শুরু করেছিলাম, প্রায় বলতে গেলে, বন্ধুত্বের টানে। অন্তরালে কোনো কোনো নারী ছিল হয়তো, কিন্তু প্রথম দিকে তা খুবই গোপন। এই তো স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি, ধুতি আর শার্ট পরা কুড়ি-বাইশ বছরের শক্তি, মুখে দাড়ি, ঘন ঘন বিড়ি খায়, কলেজ স্ট্রিট কফি হাউসে অন্য একটা দলের সঙ্গে বসে থাকে, কী সব গদ্য টদ্য লেখে। আমরা ‘কৃত্তিবাস’ পত্রিকা প্রকাশের পর শক্তি টেবিল বদলালো, একদিন লাজুক মুখে একটা চতুর্দশপদী লিখে এনে শোনালো।

    আরও দেখতে পাচ্ছি দেশবন্ধু পার্কের আড্ডা, খুবই পবিত্র ও সুকুমার দশ বারোটি ছোকরা, নেশা বলতে শুধু সিগারেট টান। আর কোন কোনদিন অন্ধকার গাঢ় হলে জামা কাপড় খুলে উদোম হয়ে ঐ পার্কের পুকুরে কিছুক্ষণ সাঁতার কেটে নেওয়া। কারুরই বাড়ীতে আলাদা কোনো বৈঠকখানা ছিল না, তাই দেশবন্ধু পার্কের আড্ডায় বিকেলের আলো ম্লান হবার আগে কেউ কেউ পকেট থেকে ভাঁজ করা কাগজ বার করে একটা দুটো পড়ে শোনাতো। যেদিন আমার কবিতা নেই, সেদিন অন্যদের কবিতা শুনতে শুনতে মনে হতো, আজই বাড়ি ফিরে রাত্রে দু একটা কবিতা লিখে ফেলতে হবে। একজনের কবিতা আর একজনকে প্রেরণা দেয়, যদিও দু’জনের কাব্যভাষা একেবারে আলাদা। 

    কবিতা পড়ার সময় শক্তি বারবারই লাজুক ছিল। আমরা সবাই তাই। এসব যখন মাঝে মাঝে শুনি, কেউ কেউ নিজের মুখে বলে, আমি একটা দারুণ কবিতা লিখেছি কিংবা আমার এই লেখাটা একেবারে নতুন ধরনের, তখন অবাক হই। আমাদের বন্ধু-বান্ধবদের মধ্যে কেউ এই ধরনের কথা বললে তাকে নির্ঘাৎ গণ-চাঁটি খেতে হতো! শক্তি একই দিনে দু’তিনটে কবিতা লিখে আনতো। ও প্রথমে কেন গদ্যের দিকে গিয়েছিল জানি না, শক্তির ভেতরে অনেক কবিতা জমে ছিল, কাব্য-আঙ্গিক ও তৈরি হয়ে গিয়েছিল আগেই, সেজন্য শক্তিকে মক্সো করতে হয়নি, অনর্গল চমৎকার কবিতা লিখে গেছে। রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দের প্রথম দিকে অনেক দুর্বল কবিতা আছে, কিন্তু শক্তির সে রকম দুর্বল কবিতা একটাও নেই।

    কবিতা লেখার সঙ্গে পাঠক-আকর্ষণ করার কোনো সম্পর্ক থাকতে পারে না। একজন নতুন কবির রচনা অন্যান্য কবিদের মধ্যে কী রকম প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। খেলাচ্ছলে শুরু করা এই যে আমাদের কবিতা, কৃত্তিবাস এবং সমসাময়িক অন্যান্য পত্রিকায় তার দাপাদাপি দেখে অগ্রবর্তী কবিরা বেশ যেন বিচলিত বোধ করেছিলেন, তাতে আমরা বেশ মজা পেয়েছিলাম। শক্তি সেই মজাটাকে অনেক দূরে টেনে নিয়ে যায়। স্যাকস্‌বি ফারমার না ঐ ধরনের কী যেন একটা কোম্পানিতে অ্যাপ্রেন্টিস হয়ে ঢুকেছিল শক্তি, ধার করা প্যান্ট-কোট পরে অফিস যাওয়া আসা শুরু করেছিল সবেমাত্র, একদিন সে সেই পোশাক খুলে ফেলে বললে, দূর ছাই! আমাদের মধ্যে শক্তিই প্রথম বা একমাত্র, পোশাক খুলেছে। ঠিকই করে ফেললো, কবিতাই লিখবে শুধু। আর কিছু না!

    এত বড় ঝুঁকি আর কেউ নেয় নি, এ এক সাঙ্ঘাতিক জুয়া খেলা। নিজের জীবনটাকেই শক্তি বাজি ফেলল। যদি দৈবাৎ কোনো দুর্ঘটনায় ওর কলম শুকিয়ে যেত, তাহলে ওর স্থান হতো কোথায়? আত্মকেন্দ্রিকতার চরমে পৌঁছতে হয়েছিল ওকে, মা-ভাই-স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-বন্ধু পরিজনের কথা মুছে ফেলতে হয়েছিল মন থেকে। এ জন্য শক্তিকে অনেকে উঞ্ছবৃত্তিও করতে হয়েছে, কিন্তু সব পরাজয়ের প্রতিশোধ খুঁজেছে কবিতায়। পাহাড়ের ভয়ংকর খাদের পাশ দিয়ে হেঁটে গেছে শক্তি, যে-কোনো মুহূর্তে মরণ ঝাঁপ দিতে পারতো। কিন্তু সে উচু দিকেই গেছে, মাঝে মাঝে পথ হারিয়ে ঘুরপাক খেয়েছে বটে, তবু নিচে নেমে আসেনি, সেইখানেই তার জয়। পেছনে ফেরার রাস্তাই সে ভুলে গিয়েছিল।

    ‘কমলা-কাঞ্চনে ভরা মোঙ্গল বাজার 
    স্বপ্নের ভিতরে, পথে অসংখ্য হোঁচট খায় চাঁদ রাত্রিবেলা
    পেছনে যাবার রাস্তা নেই...।

    শক্তিকে আমি কখনো ঈর্ষা করিনি। ঈর্ষা প্রবৃত্তিটাই বোধহয় আমার মধ্যে খুব কম, সে জন্যও অনেকে রাগ করে। একমাত্র প্রেমের ক্ষেত্রে ছাড়া, খ্যাতি-ফ্যাতির মতন তুচ্ছ ঈর্ষা করা আমার মতে ছোটলোকি ব্যাপার। নারী ঘটিত কারণে শক্তির সঙ্গে আমার কখনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়নি, শক্তির আবার ঐ প্রবৃত্তিটা কম। শক্তির কবিতার স্টাইল আমার প্রথম থেকেই খুব পছন্দ, যদিও নিজে সে রকম লিখি না। ‘শুধু কবিতার জন্য এই জন্ম’, এরকম লাইন আমি লিখেছি, কিন্তু নিজের কাছে এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করিনি, পিছিয়ে গেছি। ঐ লাইনটি বরং শক্তির ক্ষেত্রে সত্য। ভয়ংকর খাদের কিনারা ধরে হেঁটে যাওয়া, আমিও দু’একবার গেছি অবশ্য, কিন্তু শক্তির মতন অত দীর্ঘদিন ধরে আমার সাধ্য ছিল না। শব্দ ব্যবহারের ক্ষেত্রে শক্তি মাঝে মাঝে দুম করে স্বর্গীয় পাগলামি নিয়ে আসে, তা আমার আয়ত্তের বাইরে। শক্তি এমন কিছু কিছু জিনিস পারে, যা আমি পারি না। অবশ্য আমিও এমন দুটো একটা ব্যাপার পারি, যা শক্তি পারবে না!

    বেশ কয়েকটা বছর একসঙ্গে চলার পর আমি বুঝে গিয়েছিলাম, শক্তির পাশাপাশি আমি অনবরত পাহাড়ে চড়তে পারবো না। আমাকে কিছুদিন মরুভূমির ভেতর দিয়ে যেতে হবে, রাশি রাশি বালি সরিয়ে খুঁজতে হবে জল। আমি সরে গেছি। নিজের কাছে এই হার মানা স্বীকার করে নিয়েছি। সুতরাং ঈর্ষার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। দূর থেকে আমি মুগ্ধ হয়ে দেখেছি শক্তির বিপজ্জনক আরোহন, শক্তি পেরে যাচ্ছে দেখে আমার শিহরন হয়েছে।

    মাঝে মাঝে মরণ ঝাঁপ দেবার ভয় দেখিয়ে শক্তির খলখল হাসি, ওঃ তা কি ভোলা যায় কখনো; যেন সে আমার দিকেই তাকিয়ে হেসেছে। আর হাত তুলে ব্যাকুল ভাবে বলেছি, না, না, ঝাঁপিয়ো না শক্তি, অন্য দিকে ফেরো। তোমার না পারাটা আমারও ব্যর্থতা। শক্তির প্রতি এই ভালোবাসা আমার বরাবরই আছে। মনে হয়, শক্তিও তা জানে।

    (‘শক্তির কাছাকাছি’ সংকলন থেকে গৃহীত)

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @