যশোর রোডে সেপ্টেম্বর : বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের এক অনবদ্য দলিল অ্যালেন গিনসবার্গের কবিতা

বাংলাদেশ (Bangladesh) তখনও পূর্ব পাকিস্তান। নারকীয় হত্যাকাণ্ডের কারণে লাখ লাখ শরণার্থী আশ্রয় নিচ্ছে ভারতে। শরণার্থী শিবিরে অবর্ণনীয় দুর্ভোগের শিকার হয় তারা। লাখ লাখ মানুষ ভারতে আসতে থাকে যশোর রোড ধরে। প্রায় ৩০ লাখ শহীদের রক্ত, অসংখ্য সন্তানহারা মায়ের কান্না, ধর্ষিতা মেয়ের আর্তনাদের ফসল ৪৫ বছরের স্বাধীন দেশ – অধুনা বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হওয়ার যে ইতিহাস, তা আজও মনে করিয়ে দেয় যশোর রোড—অ্যালেন গিনসবার্গকে (Allen Ginsberg)। বাংলাদেশের সীমানা পেরিয়ে যশোর রোড (Jessore Road) আন্তর্জাতিকীকরণের পেছনে বিট প্রজন্মের এই আমেরিকান কবির অবদান ভোলা যায় না। এতগুলো বছর পরও দেশটির কেউ না কেউ আজও সেপ্টেম্বর (September) মাস এলেই উচ্চারণ করেন—
শত শত চোখ আকাশটা দেখে
শত শত শত মানুষের দল
যশোর রোডের দু’ধারে বসত
বাঁশের ছাউনি, কাদামাটি জল
কাদামাটি মাখা মানুষের দল
গাদাগাদি হয়ে আকাশটা দেখে
আকাশে বসত মরা ঈশ্বর
নালিশ জানাবে ওরা বলো কাকে?
*মৌসুমী ভৌমিকের ভাবানুবাদে গিনসবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-এর প্রথম দু’টি স্তবক
অরউইন অ্যালেন গিনসবার্গ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের (Bangladesh Liberation War) এক অনবদ্য দলিল গিনসবার্গের ‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’ (september on jessore road), এ নিয়ে কোনও সংশয় নেই। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আমেরিকা (America) থেকে কবি এসেছিলেন যশোর রোডে। উদ্দেশ্য ছিল বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের দুঃখ-দুর্দশা নিজ চোখে দেখা। এর আগেও বেশ কবার ভারতে এসেছিলেন তিনি। এবার তার সঙ্গী হলেন বিবিসির হয়ে রিপোর্ট করতে আসা গীতা মেহতা ও সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। যশোর রোড কলকাতার কাছাকাছি হওয়ার ফলে দেখতে চেয়েছিলেন শরণার্থী ক্যাম্পগুলো। কিন্তু অতিবর্ষণের ফলে যশোর রোড তখন সম্পূর্ণ ভাসমান। নৌকা ছাড়া দ্বিতীয় কোনো উপায় ছিল না। এত প্রতিকূলতার মধ্যেও পিছু হটেননি। নৌকাযোগে পৌঁছান যশোর সীমান্তে। গিনসবার্গ দেখেছিলেন বেনাপোলের ওপারে ভারতের পেট্রাপোল থেকে কলকাতা পর্যন্ত যশোর রোডে শরণার্থীর ঢল। বাস্তুহারা এসব অসহায় শরণার্থীর অশ্রুর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে কবি কলম ধরেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য।
Millions of babies watching the skies
Bellies swollen, with big round eyes
On Jessore Road -long bamboo huts
No place to shit but sand channel ruts
Millions of fathers in rain
Millions of mothers in pain
Millions of brothers in woe
Millions of sisters nowhere to go
One Million aunts are dying for bread
One Million uncles lamenting the dead
Grandfather millions homeless and sad
Grandmother millions silently mad
Millions of daughters walk in the mud
Millions of children wash in the flood
A Million girls vomit & groan
Millions of families hopeless alone
*‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’-এর শুরুর অংশ
গিনসবার্গের এই কবিতাটি একেবারে শুরুতে, বাংলাদেশ স্বাধীনতার পর অনুবাদ করেছিলেন খান মোহাম্মদ ফারাবী (Khan Mohammad Farabi)। বাংলাদেশের স্বনামধন্য চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ (Tareque Masud) ‘মাটির ময়না’ নির্মানের আগে, একটি তথ্যচিত্রের (মুক্তির কথা, ১৯৯৮) জন্য বিশিষ্ট সংগীতকারী মৌসুমী ভৌমিককে (Moushumi Bhowmik) একটি গান গাওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। পরবর্তীতে যে গানটি ‘যশোর রোড’ নামে প্রভূত জনপ্রিয়তা পাবে। গিনসবার্গের কবিতা ‘যশোর রোড’ হয়ে ওঠে একটি পরিপূর্ণ গান; মৌসুমী ভৌমিকের কণ্ঠে-ভাবানুবাদে। কেতকী কুশারি ডাইসন লন্ডনের এক মহিলা মিউজিশিয়ানের সঙ্গে তাঁর আলাপ করিয়ে দিয়েছিলেন। মৌসুমী ভৌমিকের নির্দেশ মতো সুর বেঁধে দেন সেই মিউজিশিয়ান। ‘জন উইলসন’ স্টুডিওতে ভায়োলিন ও পিয়ানোর সুরে রেকর্ড করা হয় যশোর রোড। শুধু দুই বাংলা নয়, সারা বিশ্বে এখনও অসম্ভব জয়প্রিয় এই গান।
নাসির আলী মামুন গিনসবার্গের একটি সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন। সেটি প্রকাশিত হয়েছিল ‘প্রথম আলো’ পত্রিকায়, ২০১৯ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর। ওই সাক্ষাৎকারে গিনসবার্গ বলেছেন, ‘‘...শরণার্থী শিবিরে ঘুরে নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছিল আমার। অক্টোবরে নিউইয়র্কে ফিরে গেলাম। প্রতিদিনই ভাবতে থাকি, বাংলাদেশের জন্য আমি কী করতে পারি। হঠাৎ মাথায় এলো, আমি কবিতা লিখতে তো পারি। লিখেও প্রতিবাদ করা যায়। কদিন ঘরে থেকে লিখলাম দীর্ঘ কবিতা—‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’।’’
সফর শেষে যুক্তরাষ্ট্রে ফিরে নিউ ইয়র্কে টানা তিন দিন বসে গিনসবার্গ লিখেছিলেন ঐতিহাসিক সেই কবিতা। পরবর্তী সময়ে কবিতাটি তিনি বিভিন্ন জায়গায় পাঠ করেন। বাংলাদেশের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে সবার কাছে সাহায্যের জন্য হাত পাতেন। মুক্তিযুদ্ধকে শাণিত করার জন্য কবিতার মাধ্যমে গড়ে তোলেন বিশ্ব জনমত।
মার্কিন সরকার তো নির্যাতনের বিপক্ষে কিছুই বলছে না, উল্টে পাকিস্তানকে সমর্থন করে যাচ্ছে। এসব দেখেই নিউ ইয়র্ক ফিরেছিলেন গিনসবার্গ। প্রথমে কবিতার শিরোনাম রেখেছিলেন ‘যশোর রোড’। এরপর ১৯৭১ সালের ২০ নভেম্বর, সেইন্ট জর্জ চার্চে ‘বাংলাদেশের জন্য মার্কিনিরা’ শীর্ষক কবিতা পাঠের আসরে তা আবৃত্তি করেন। অগণিত দর্শকের মধ্যে সেখানে বব ডিলানও (Bob Dylan) উপস্থিত ছিলেন। ডিলান গায়ক, একজন কবিও। নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে অগাস্টের ১ তারিখ অনুষ্ঠিত হয় ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’ (The Concert for Bangladesh)। গান হয়ে গেল ‘যশোর রোড’—‘সেপ্টেম্বর অন যশোর রোড’। গানে কণ্ঠও দেন গিনসবার্গ আর গিটারে ডিলান। জন লেননের পরামর্শে ১৯৮৩ সালে গানটি রেকর্ড আকারে প্রকাশ পায়। কবিতাটি তারও আগে, প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় ‘যশোর রোড’ নামে। যদিও ১৫২ লাইনের সুদীর্ঘ কবিতাটির অর্ধেক ছাপা হয়েছিল। ছবি এঁকেছিলেন ড্যানিশ ব্যঙ্গচিত্র আঁকিয়ে ক্লাউস অ্যালব্রেকস্টেন। পুরো কবিতাটি গ্রন্থভুক্ত হয় গিনসবার্গের ‘দ্য ফল অব আমেরিকা’ কাব্যগ্রন্থে (১৯৭২ সালের ১ জুন প্রকাশিত)। কবিতার জন্য বইটি আমেরিকার ‘ন্যাশনাল বুক’ অ্যাওয়ার্ড পায়।
এ প্রসঙ্গে কবিতা ও গানের খবরাখবর নিয়ে বব ডিলানের প্রকাশনা ‘ডিলান ১০’ এর বসন্ত সংখ্যায় গিনসবার্গ লেখেন,
“আমার ইচ্ছা ছিল, বব ডিলানকে চমকে দিয়ে একটা গান লিখব। অনেকটা উইলিয়াম কার্লোস উইলিয়ামসের ‘স্যাড-আইড লেডি অব দ্য লো ল্যান্ডস’-এর মতো লম্বা কোনো গান, যা প্রকৃতির সৌন্দর্য আর মানবিক আকুতি জাগাবে, যা ডিলানকে ভাবাবে, কাঁদাবে। আমি তা-ই লিখতে চেষ্টা করলাম। সম্প্রতি কলকাতা ঘুরে লাখ লাখ মানুষের সীমাহীন দুঃখ-কষ্ট দেখে আমার যে অনুভূতি তৈরি হয়েছে, তা-ই লিখলাম। কলকাতার ভাষা আর সংগীতের মিশ্রণে সেটিকে গানে রূপ দিলাম ভারতীয় হারমোনিয়াম সহযোগে। সে সময়ে দেখা মানুষগুলোর অন্তহীন যাতনা আমাকে নির্বাক করেছিল। সব বয়সের মানুষের বেঁচে থাকার কষ্ট আমার বুকে চেপে বসে ছিল। সেই যাতনা হৃদয়ে নিয়েই আমি লিখেছিলাম ‘যশোর রোড’ কবিতা”।
প্রসঙ্গত, ১৯৫৫ সালে আমেরিকা আর ভিয়েতনাম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, তখন আমেরিকার রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা এর বিরোধিতায় সোচ্চার হন। দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে ভিয়েতনাম যুদ্ধবিরোধী বিক্ষোভ, শুরু হয় ‘হিপি মুভমেন্ট’। সেই সময়ের আমেরিকান লেখক, কবি, গায়ক, বাদক, শিল্পী, ছাত্রছাত্রী সকলেই এই যুদ্ধবিরোধী আন্দোলনে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহন করেছিলেন। একেবারে সামনের সারিতে ছিলেন গিনসবার্গ, যুদ্ধের বিপরীতে যাঁর শব্দবন্ধ ‘ফ্লাওয়ার পাওয়ার’ সারা বিশ্বকে নাড়িয়ে দিয়েছিল। ভারতভ্রমণে অনেকটা সময় কাটিয়েছিলেন তাঁর প্রিয় শহর কলকাতায়। সে সময় আমেরিকায় তিনি চরম বিতর্কের কেন্দ্রে।
বিট সাহিত্য আন্দোলন, যুদ্ধবাজ মার্কিন প্রশাসনের তীব্র সমালোচনা, কিউবার পক্ষ সমর্থন, সমকামিতা, ভিয়েতনাম-যুদ্ধের বিরোধিতা এসব তো ছিলই, তার সঙ্গে ‘হাউল’ লেখার দায়ে পুলিশ তাঁর কবিতাও বাজেয়াপ্ত করে।গিনসবার্গকে কলকাতা আসার টাকা দিয়েছিলেন ব্রিটেনের জনপ্রিয় রক-ব্যান্ড ‘রোলিং স্টোনস’-এর কিথ রিচার্ডস। কলকাতায় এসে লেখকবন্ধু পিটার অরলোভ্স্কি, জন গিয়ার্নো-কে নিয়ে উঠেছিলেন চাঁদনীর আমজাদিয়া হোটেলে। থেকেছিলেন বুদ্ধদেব বসুর বাড়িতে, হাংরি-কবি মলয় রায়চৌধুরি ও সমীর রায়চৌধুরির পাটনার ‘চাইবাসা’য়, আবার কখনও সুনীল গাঙ্গুলীর ডেরায়।
শঙ্খ ঘোষ যথার্থই লিখেছিলেন, বিংশ শতকের ওই দশকে কাউন্টার কালচার, ভিয়েতনাম, হিপি আন্দোলন, হাংরি জেনারেশন, গিনসবার্গের কলকাতা ভ্রমণ, বিশ্বজোড়া ছাত্রবিদ্রোহ, নকশালবাড়ির বজ্রনির্ঘোষ এবং মনীষীদের মূর্তিভাঙার মধ্যে বাংলায় চারিয়ে যাচ্ছিল যে পিতৃমাতৃঘাতী ক্রোধ, তার তলায় অন্তঃসলিলা ফল্গুনদীর মতো কি আসলে কাজ করেনি ওই দেশভাঙার, ভিটেছাড়ার, আমূল দুঃখ?
তথ্যসূত্রঃ
চলচ্চিত্র পরিচালক তারেক মাসুদ সঞ্চালিত মৌসুমী ভৌমিকের সাক্ষাৎকার, দেশ টিভি, মার্চ ২০১১
প্রথম আলো
Roar Media
bangladeshpost.net
আনন্দবাজার পত্রিকা
dailyasianage.com
www.observerbd.com