No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    সিপাহী বিদ্রোহ এবং প্রভুভক্ত বাঙালি বাবুদের গপ্প

    সিপাহী বিদ্রোহ এবং প্রভুভক্ত বাঙালি বাবুদের গপ্প

    Story image

    “হঠাৎ দেশে উঠল আওয়াজ হো হো হো হো হো হো
    চমকে সবাই তাকিয়ে দেখে সিপাহি বিদ্রোহ!”

    সবার কথা জানি না। তবে কলকাতার বাঙালি বাবুরা চমকে উঠে, ঢোক গিলে, হাঁ করে তাকিয়ে দেখেছিল সেই ঘটনা। আর তার নাম দিয়েছিল ‘সিপাই ক্ষেপা’।

    প্রথম ঘটনাটি ঘটে জানুয়ারি মাসে। শীতের উত্তুরে হাওয়ায় হঠাৎই দমদমের সেনা ছাউনির দুজন এদেশি সেনা ক্ষেপে ওঠে। সাহেবদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু হয়। ফেব্রুয়ারিতে বহরমপুরেও একই ঘটনা। আর ঠিক তার কিছুদিন পরেই মঙ্গল পান্ডের সাহেব-আক্রমণ। এনফিল্ড রাইফেল শুধু না, সিপাইদের ক্ষোভের কারণ লুকিয়ে ছিল দীর্ঘদিনের নির্যাতনে, বৈষম্যে। তামাম উত্তর ভারতেও সেপাইরা নড়েচড়ে উঠেছে ততক্ষণে। দিল্লিতে আবার বাদশা সিংহাসনে বসে রাজ করবে। ইংরেজকে এবার ভারত ছাড়তেই হবে। নানা সাহেব, তাঁতিয়া টোপিরা নেতৃত্ব দিচ্ছেন। 

    শীত, বসন্ত পেরিয়ে গ্রীষ্মও চলে আসে হুড়মুড়িয়ে। প্যাঁচপ্যাঁচে গরমে ইংরাজের গায়ে ভয়ের কাঁটা, আর একই ভয়ে শিহরিত বাঙালি বাবুরাও।

    কলকাতা নিয়ে ইংরেজদের বরাবরই একটা আলাদা অধিকারবোধ ছিল। অন্য জায়গা চুলোয় গেলেও সাধের কলকাতা যেন সুরক্ষিত থাকে। শুধু রাজধানী বলে না। অনেক আহ্লাদ করে গড়ে তোলা শহর। জলাজমি সব চেছে পুছে, পগার সাফ করে এই শহর গড়া। শহরে রোগের প্রকোপও কম ছিল না। তাতে বহু স্বনামধন্য ব্রিটিশকে অকালে প্রাণ দিতে হত। আর বিশ্রী আবহাওয়া তো ছিলই। কিন্তু, তারপরেও ইংরেজের সঙ্গে বড়ো মায়াময় সম্পর্ক ছিল কলকাতার। অধিকারবোধ এমনই ছিল, পলাশির যুদ্ধজয়ের খবরের চেয়েও বেশি গুরুত্ব দিয়ে ইংল্যান্ডের মহারানির কাছে অন্য খবর পাঠিয়েছিলেন ক্লাইভ-- আলিনগরের নাম ফের ‘কলকাতা’ করার চুক্তিতে সই করেছেন মীর জাফর। ‘কলকাতা’ এমনই স্পর্শকাতর জায়গা।

    আর কলকাতার প্রতি লেপ্টালেপ্টি টান ছিল বড়োলোক বাবুদের। কলকাতা নগর হল বলেই না তাঁরা জন্মালেন। পরিবারে বাড়লেন। ইংরেজি স্কুল কলেজে পড়তে গিয়ে ইংরেজি শেখা হল। তাই কলকাতায় ব্রিটিশদের দুরবস্থায় বাবুদের মহাভাবনা।

     আমরা এখন বলি কতগুলো গালভরা কথা—১৮৫৭-র মহাবিদ্রোহ জন্ম দিল জাতীয়তাবাদের। যে জাতীয়তাবাদ আধুনিকতারও লক্ষণ। দুইয়ে-দুইয়ে চার হল। জন্ম নিল কলকাতার শিক্ষিত বাবুদের ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। যদিও, তৎকালীন কলকাতার অধিকাংশ বাবুদের ক্ষেত্রে ছবিটা ছিল ঠিক উলটো। তাঁরা খুবই সমস্যায় পড়েছিলেন এই বিদ্রোহের খবরে। বরং, এই গোটা পর্যায়ে তাঁরা সরাসরি ছিলেন ব্রিটিশরাজেরই পক্ষে। 

    ১৮৫৭-এর মাঝামাঝি। বিদ্রোহ দমন করতে তখন সাজো-সাজো রব। বিদ্রোহী সেপাইদের প্রতি বিন্দুমাত্র আস্থাশীল নন কলকাতার ধনী বাঙালিরা। পাছে তারা কলকাতা আক্রমণ করে তাদের ধনদৌলত ডাকাতি করে? দুশ্চিন্তায় বাবুদের ঘুম হয় না। এদিকে ব্রিটিশ ভলান্টিয়ার বাহিনী দু-দলে বিভক্ত হয়ে তখন কলকাতা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। মধ্যরাতে একদল চৌরঙ্গী, আরেকদল বাঙালিটোলা পাহারা দেয়। ফাঁকা বন্দুক ছোড়ে। আর বাড়ির গিন্নি ইষ্টনাম জপ করেন। কিন্তু তাতেও বাঙালিবাবুর ভয় যায় না। এত কষ্ট করে লাখপতি হয়েছেন তাঁরা। দিব্বি সভা-সমিতি, মিটিং, বুলবুলি নাচ আর বাইনাচে দিন কাটাচ্ছিলেন। তা না হঠাৎ করে উপদ্রব। কাজেই পাইকপাড়ার রাজবাড়ি থেকে শুরু করে, শোভাবাজার রাজবাড়ি, দত্তবাড়ি, মল্লিকবাড়ি, শীলবাড়ি, রানি রাসমণির বাড়ি, ঠাকুরবাড়ি, ঘোষবাড়ি, মিত্রবাড়ি, বসুবাড়ি-- সর্বত্র পাহারা বসল। গোরা সৈন্য আর দেশি সৈন্য মিলিয়ে প্রতি ধনীবাড়ির নিচে প্রহরা। কোনো কোনো ধনী বাড়িতে পাহারাদারের সংখ্যা শতাধিক। এমনি প্রহরা নয় কিন্তু। গোরা সেনার পকেটে পিস্তল।  বাঙালিবাবুরা পারলে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে গিয়ে আশ্রয় নেয়। কারণ প্রতিদিনই শহরে গুজব রটত সেনাবাহিনী কলকাতায় অগ্রসর হচ্ছে। তারা ব্যারাকপুর থেকে রওনা দিয়েছে।

    ব্রিটিশ পাহারার প্রতিশ্রুতি দিলে বাঙালিবাবুদেরও কৃতজ্ঞতা বাড়ে। সাদা চামড়ার মানুষগুলো মেহনত করছে এত। কিছু তো করা উচিত। কলকাতায় রামগোপাল মল্লিকের বাড়িতে সভা বসে। তথাকথিত মান্যগণ্য বাবুদের সমাগম হয়। সেখানে স্থির হয়, ব্রিটিশকে যেকোনোরকম সাহায্যের জন্যে তারা প্রস্তুত। ‘সংবাদ প্রভাকর’-এর ২৬ মে, ১৮৫৭-র খবর অনুযায়ী, সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন রাজা রাধাকান্ত দেব, রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, রাজেন্দ্র দত্ত, হরচন্দ্র ঘোষ, কালীপ্রসন্ন সিংহ প্রমুখ। উজ্জ্বল সমস্ত নাম সন্দেহ নেই। একাধিক সভা হয়েছিল এই আনুগত্য প্রদর্শনকে উপলক্ষ করে।

    বিদ্রোহ অবশেষে থামে। ছেলে ঘুমালো/পাড়া জুড়োলো-এর মতো করে কলকাতাবাসীর ব্যথা জুড়োয়। বিদ্রোহে সাহেবদের জয়কে কেন্দ্র করে কলকাতার রাস্তায় গানও তৈরি হয়। কিন্তু, কেন সেদিন কলকাতার বিদ্বজ্জন বিদ্রোহী সিপাইদের ভালো চোখে দেখলেন না, তা নিয়ে প্রশ্ন জাগে বৈকি। নিখাদ ধনীদের কথা ছেড়ে দিলেও, বিদ্বজ্জনও তো তখন নেহাৎ কম ছিল না। সংবাদপত্রের কণ্ঠরোধেও তারা কথা কইলেন না। সিপাই বিদ্রোহকে এত ভয় পেলেন কেন তারা? 

    ইতিহাস অবশ্য বারবারই দিকপরিবর্তন করে। সেদিনের ভয়ে সেঁধিয়ে থাকা কলকাতাবাসী জেগে উঠছিল তার পরের দশক থেকেই। হয়তো সেদিনের আনুগত্যের বাইরে একটা আগুন তৈরিও ছিল। সেদিনের অল্প আঁচে তা জেগে ওঠেনি। অথচ ঠিক সে ঘটনার পর থেকেই, পত্রপত্রিকায়, নাটকে, কাব্যে, গল্পে, উপন্যাসে ব্রিটিশ খেদানোর বোমা পড়তে থাকে। হয়তো পরে আরো অনেকটা জ্বলে উঠবে বলেই সেদিনের নৈঃশব্দ প্রয়োজন ছিল। কে জানে? ইতিহাস এর হদিশ দেয় না।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @