সিক্রেট সুপারস্টার - যে গল্পটা জানলার

পনেরো বছর বয়সী ইনসিয়া তার মা নাজমার প্রিয় বন্ধু। ইনসিয়ার পুঁচকে ভাই গুড্ডু বাবা আর ঠাকুমার একটু বেশি আদরের। ইনসিয়ার তো কথাই ছিল না-জন্মানোর। ‘লড়কি প্যায়দা করে কী লাভ হয়!’ ইনসিয়ার তো কথাই ছিল না, জন্মানোর - যদি না কন্যাভ্রূণ হত্যার চক্রান্ত বানচাল করে প্রথমবার গর্ভবতী নাজমা পালিয়ে যেত হাসপাতাল থেকে। মেয়ের চোখে ছেলেমানুষ, বোকা আর কিচ্ছু না-বোঝা মাকে জড়িয়েমড়িয়ে থাকা ইনসু গান গেয়ে সুপারস্টার হতে চায়। ভাবে, তার কণ্ঠ একদিন সারা দুনিয়া শুনতে পাবে ঠিক। গৃহবধূ মা তাকে গলার হার বিক্রি করে গোপনে ল্যাপটপ কিনে দেয়। সেখানে ইনসিয়া গানের ভিডিও তৈরি ক’রে ইউটিউবে আপলোড করতে চায়। কিন্তু কীভাবে! আব্বা জানতে পারলে তো মেরে ফেলবে সব্বাইকে! গুড্ডুর বাবা মানে নাজমার স্বামী, আক্ষরিকই ‘স্বামী’, যে হার বিক্রির কথা জানতে পেরে কোমর থেকে বেল্ট খুলে ক্রমাগত মারতে থাকে নাজমাকে, গিজারের সুইচ অন করতে ভুলে গেলে যে মেরে ঠোঁট ফাটিয়ে দেয় নাজমার, কোচিং ক্লাসে ফেল করলে যে পেন দিয়ে অবলীলায় ছিঁড়ে ফেলে ইনসিয়ার প্রিয় গিটারের তার। বলিউডে একঘরে হয়ে যাওয়া সঙ্গীত পরিচালক শক্তি কুমার ইনসিয়াকে ডেকে পাঠায় মুম্বইয়ে। ইনসিয়ার ক্লাসের একমাত্র বন্ধু চিন্তন, যে আসলে ইনসুর কিশোর প্রেমিকও, সে তার মোবাইল ফোনে প্রেমিকার সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয় শক্তি কুমারের। এরপর ধাপে ধাপে স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি।
চলচ্চিত্রে আমরা তাই-ই দেখতে চাই যা বাস্তবতার অতিসন্নিকটে বিচরণ করে, অথবা, যা অবস্থান করে বাস্তবতার একেবারে দূরতম দেশে। অদ্ভেত চন্দনের ছবি এই দুই আকাঙ্ক্ষাকে এক জায়গায় এনে বসায়। ফলত এ গল্প যতটা ‘লার্জার দ্যান দ্য লাইফ’, ঠিক ততটাই ‘নেক্সট ডোর রিয়্যালিটি’। আমরা চাই ইনসিয়া স্কুল বাংক করে, বাড়িতে না জানিয়ে, যেভাবেই হোক পৌঁছে যাক শক্তি কুমারের ষ্টুডিওয়। আমরা চাই, মার খেতে খেতে বেধড়ক মার খেতে শোষিত নাজমা একবার হাত তুলে রুখে দাঁড়াক শোষক শোহরের বিরুদ্ধে। আর আমরা যা চাই, অন্তত তা রূপোলি পর্দায় সত্যি হলে দৃশ্যশ্রাব্যের সামনে দাঁড়িয়ে আমাদের রক্তকণিকায় চারিয়ে যেতে থাকে সুখস্রোত।
নারী স্বাধীনতা? অধিকার বুঝে নেওয়া প্রখর দাবি? গার্হস্থ্য হিংসার সঙ্গে লড়াই? এইসব উপমহাদেশীয় সামাজিক সমস্যায় ভর দিয়ে যে ছবির নির্মাণ হয়, তার আদিতে থাকে একটি অবয়ব। একটি জানলার অবয়ব। নাজমার রান্নাঘর থেকে বৈঠকখানার মাঝে একটি আয়তক্ষেত্রাকার জানলা – নাজমা কথা বলে – নাজমা স্বামীর আদেশ পালন করে – নাজমা রান্না করে পরিবারের জন্য– বৈঠকখানায় বসানো ক্যামেরায় আমরা দেখতে পাই, জানলার মধ্যে দিয়ে নাজমার মুখ ধরে আছে একটি চৌকোনো জানলার অবয়ব। নাজমা জানলা চেনে। কিন্তু জানলার বাইরে যে বিশ্ব, তাকে ছুঁয়ে দেখার সাহস সে অর্জন করতে পারেনি এ যাবৎ। তাই ইনসুর স্বপ্নকে প্রশ্রয় দেয়, বুকে আগলে লালন করে, আর একে একে জানলাগুলোকে খুলে দিতে চায় ইনসিয়ার। ইনসিয়া ট্রেনের জানলায় ধরে বসে গান শোনায় বন্ধুদের। ইনসিয়া বসে থাকে স্কুলের জানলায়। আর বাড়ি ফিরে প্ল্যান লিখতে থাকে হোমওয়ার্কের খাতায়। অনেকগুলো পরিচিত জানলার ভিড়ে এক প্রকৃত জানলার সন্ধান। ইনসিয়া গান গেয়ে তার ইউটিউব চ্যানেলে পোস্ট করবে। কিন্তু কেমন করে গোপন রাখবে তার পরিচয়? নাজমা আলমারি থেকে একটা বোরখা বার করে দেয়। প্রথমে নিমরাজি হলেও ইনসিয়া দেখে ওটাই একমাত্র রাস্তা। হিজাবের মধ্যে যেটুকু ফাঁক, সেই একফালি জানলার ভেতর দিয়ে ইনসিয়ার দুটো জ্বলজ্বলে চোখ চোখে পড়ে। যে বোরখা ‘অপ্রেশন’, যে হিজাব ‘অর্থোডক্সি’, তা-ই ক্রমে জানলা হয়ে ওঠে মা-মেয়ের যৌথতায়। হয়ে ওঠে বিপ্লব। বরোদা থেকে মুম্বই যাবে বলে মফস্বলের একরোখা কিশোরী প্রথমবার একা একা ফ্লাইটে উঠছে। চিন্তন তাকে বলে দিয়েছে উইন্ডো-সিট নিতে। ইনসিয়া ফ্লাইটে এসে দেখে, তার হক্কের সিটে বসে আছে অন্য কেউ। ইনসিয়া প্রশ্ন করে। ইনসিয়া রুখে দাঁড়ায়। কেননা ওই জানলাটা তার। ওই আকাশের আলোয় আলোয় যে মুক্তি, সে আলো, সে আকাশ, সে জানলা ইনসিয়ার। ইনসিয়ার একার।যে লড়াই ইনসিয়া জিতে যাবে বলে আমাদের এই সেলুলয়েড জার্নি, তার শেষ মুহূর্তের কাছাকাছি এসে নাজমা বলে - যা ইনসু, এবার তোর উইন্ডো সিট নিয়ে নে। স্পট লাইট উপচে পড়ে কখনও হার না-মানা কিশোরীর মুখে। নিজেকে বোরখার আবডালে রাখা ইউটিউব সেনসেশন ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ তার বোরখা খুলে ফেলে। কেননা ওই জানলা খুললেই তো আকাশ। আর এ কথা কে না জানে, যারা স্বপ্নে বাঁচে, যাদের ভোর হয় স্বপ্ন দেখবে বলে, তাদের ডানার উড়ান আটকাতে পারে না কেউ!