টাকির সিক্রেট রান্নাবান্না

সুনন্দা বোস
টাকি। ইছামতী নদীর ধারে পুরনো শহর। দু’বাংলার মিলনবিন্দু বললেও ভুল কিছু নয়। নদীর দু’ধারের মানুষের ভাষা পোশাকে দেশ-বিদেশ ভেদাভেদ বোঝা না গেলেও নদীর উপর ক্রমাগত টহল দেওয়া বোটের মাথায় উড়তে থাকা পতাকা দেখে পার্থক্যটা বোঝা যায়। তবু একটা নদী তো আর দু’পারের সংস্কৃতির বিশাল কিছু ফারাক ঘটিয়ে দিতে পারে না! মিলের সূক্ষ্ম স্রোত পারাপার করে প্রায়ই। আর এই মিলনের প্রভাব পড়েছে আচার-আচরণ থেকে রান্নাবান্নাতেও। এপার ওপার মিলে তৈরি হয়েছে টাকির নিজস্ব স্বাদখবর।
টাকি খাদ্যতালিকায় আমিষ-নিরামিষ সকলেরই উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। যেহেতু টাকি মাছের রাজ্য সুন্দরবনের গেটওয়ে, তাই মাছ দিয়ে হরেকরকম আয়োজন হয়। এখানে নিরামিষ রান্নার মশলা ব্যবহার খুব কম করা হয়। কিন্তু রান্না মশলা ছাড়াই করা হয়। আগে এই নিরামিষ খাবার খাওয়া হত ব্রত বা উপবাসের দিনগুলিতেই। তবে পরিবারের বিধবারা প্রতিদিনই নিরামিষ খেতেন। তাঁরা যেখানে রান্না করতেন তাকে বলা হত হবিষ্যিঘর। আর যেখানে মাছ, মাংস, পেঁয়াজ, রসুন দিয়ে রান্না করা হত তাকে বলা হত আমিষঘর। আর এই সব হবিষ্যিঘরেই তৈরি হত এক-একটি সুস্বাদু নিরামিষ রান্না। নানাধরনের সবজি দিয়ে ডাল, শুক্তো, নানারকমের ভাজা, তরকারি, চাটনি চেখে দেখার নাম করে কত চেয়ে খেয়েছি। সেইসবের স্বাদ আজ আর পাই না। কিন্তু সেইগুলি যে অনেক মশলা দিয়ে তৈরি হত তা কিন্তু নয়। মশলার তালিকায় থাকত জিরে, ধনিয়া, মৌরি, পাঁচমশলা, গরমমশলা, তেজপাতা, সরষে, রাধুনি। স্বাদ বাড়াতে ব্যবহার করা হত বাড়ির তৈরি খাটি দুধের ঘি। এখানকার রান্নাঘরে পেঁয়াজ ও রসুনের ব্যবহার খুবই কম। এখানকার পুরনোবাড়িতে একটি সিক্রেট মশলার খবর পাওয়া যায়। একে বলা হয় গোটা মশলা। গরমের শুরুতেই এখানকার বাড়িতে আজও গোটামশলা ও কাসুন্দি তৈরির প্রথা আছে।
গরমের শুরুতেই বাড়িতে বাড়িতে একটা পুজোর আয়োজন করা হত। বিভিন্ন ধরনের মশলা ভালো করে ধুয়ে রোদে শুকোতে হয়। তারপর মেয়েরা পুকুরে স্নান করে এলে, মশলাগুড়ো করার ঢেঁকিকে পুজো দিয়ে সেইসব শুকনো মশলাগুলি কুটে গোটা মশলা তৈরি করা হত।

কাসুন্দি, আচার, বড়ি তৈরির করার সময়ও এইধরনের নিয়ম পালন করা হত। বর্তমানে এখানে শহরের ছাপ পড়লেও অনেকবাড়িতে শুরু গরম পড়তে না পড়তেই শুরু হয়ে গিয়েছে গোটামশলা, কাসুন্দি, আচার ও বড়ি তৈরির অনুষ্ঠান।
আরও পড়ুন
নাটোরের রান্নাঘর থেকে

এই সব ঘরে তৈরি করা মশলা ও বড়ি যখন খাবারে পরে তখন অন্য মাত্রা যোগ করে। তাছাড়া এখানে বাড়িতে বড়ি দেওয়াকে খুব শুভ মানা হয়। এখানে বিয়ের পর মেয়ের বাড়িতে শীতকালীন তত্ত্ব পাঠানোকে শুভ মানা হয়। নানাধরনের ডালের সঙ্গে টক বড়িও তৈরি করা হয়। যেমন কদ্বেলের বড়ি। রোদের শুকোতে দেওয়া এইসব বড়ি বাড়ির ছোট থেকে বড়দের সকলের খুব প্রিয়।

এখানকার শুক্তোর বিশেষত্ব হল - সরষে বাটা, অল্প আদা পেস্ট ও লাল লঙ্কার বাটা দেওয়া হয়। কাঁচাকলা, পটল, মুলো, বেগুন, আলু, মিষ্টি আলু, শিম, বরবটি, উচ্ছে, সজনেডাটা এইসব সবজিগুলি মাঝারি আয়তনে কাটতে হবে। অল্প তেলে সবজিগুলি একটু ভেজে নিয়ে অল্প গোটামশলা, সরষেবাটা, তেজপাতা, অল্প লাল লঙ্কাবাটা দিয়ে কড়াইতে কষিয়ে অল্প জল দিয়ে কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে। শেষে একচিমটি ময়দা ব্যবহার করা হয় শুক্তো তৈরি করা হয়। গোটা মশলা ব্যবহার করে মৌরলা মাছ, কুচো চিংড়ির ঝোল, গোটার ঝোল, মৌরলা মাছের শুক্তোর মত নানাধরনের জিভে জল আনা খাবার তৈরি করা হয়।
