বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে অগ্রণী ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসু

সত্যেন্দ্রনাথ বসু তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতেন। পড়ুয়াদের কোয়ান্টাম তত্ত্ব বোঝাতে গিয়ে তিনি একটি ভুল করেছিলেন। কিন্তু সেই ভুলটিই অসাধ্যসাধন করল। উনিশ শতকের শেষে কৃষ্ণবস্তুর বিকিরণের একটি সমস্যা চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল সারা দুনিয়ার তাবড় বিজ্ঞানীদের। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী ম্যাক্স প্লাংক ১৯০০ সালে সমস্যাটির একটি সমাধানসূত্র খুঁজে বের করেন, যাকে বলা হয় প্লাংকের সূত্র। এই সূত্রকে বিজ্ঞানীরা গ্রহণ করলেও তা যেভাবে উপস্থাপনা করা হয়েছিল, সেটা নিয়ে রয়ে গিয়েছিল ধন্দ। অ্যালবার্ট আইনস্টাইনও এই নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু তাঁর ভুলের মাধ্যমে সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি পদ্ধতিতে প্লাংকের সূত্রে উপনীত হন।
এই নিয়ে বিস্তারিত গবেষণা করে পদার্থবিদ্যার এক বিশ্বখ্যাত জার্নালে প্রবন্ধ লিখে পাঠান সত্যেন্দ্রনাথ। কিন্তু সেই জার্নাল তাঁর লেখা প্রকাশ করতে চায়নি। তখন নিজের লেখাটি তিনি আইনস্টাইনের কাছে পাঠালেন। অনুরোধ করলেন, লেখাটিকে বিখ্যাত জার্নাল ‘Zeitschrift für Physik’-এ প্রকাশের ব্যবস্থা করার জন্য। সত্যেন্দ্রনাথের গবেষণা আইনস্টাইনকে মুগ্ধ করেছিল। তিনি প্রবন্ধটিকে জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে সেই জার্নালে ছাপানোর জন্য দিলেন। সঙ্গে নিজের মন্তব্যও যোগ করলেন, যাতে বলা ছিল, এগিয়ে যাওয়ার পথে লেখকের এই কাজটিকে খুবই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন আইনস্টাইন। সত্যেন্দ্রনাথের আবিষ্কার করা পদ্ধতি ‘বসু-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব’ হিসেবে পরিচয় লাভ করে।
সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে সম্মান জানিয়ে বিজ্ঞানী পল ডিরাক পদার্থের এক ধরনের মৌলিক কণার নাম দিয়েছিলেন ‘বোসন’। এই কণাগুলি ‘বসু-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্ব’ মেনে চলে। আরও এক রকমের মৌলিক কণা আছে, যার নাম ফার্মিওন। ইতালির পদার্থবিজ্ঞানী এনরিকো ফার্মির নাম অনুসারে যার নাম রাখা হয়েছে। ১৯৩৮ সালে ফার্মি নোবেল পুরস্কার লাভ করেছিলেন। ডিরাকও নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন ১৯৩৩ সালে। কিন্তু সত্যেন্দ্রনাথ বসু নোবেল কমিটির কাছে উপেক্ষিতই রয়ে গেলেন। যদিও বিশ্ব পদার্থবিদ্যার ইতিহাসে সত্যেন্দ্রনাথ বসুর অবদান সোনার অক্ষরে লেখা থাকবে।
পৃথিবীর সেরা বিজ্ঞানীদের একজন ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। নানা ভাষায় পাণ্ডিত্য অর্জন করে তিনি বুঝেছিলেন, মাতৃভাষাই বিজ্ঞানচর্চার সেরা মাধ্যম। পৃথিবীর নানা দেশের গবেষকরা নিজেদের ভাষায় সফলভাবে বিজ্ঞানচর্চা করে থাকেন, তা দেখেছিলেন তিনি।
হায়দ্রাবাদে অনুষ্ঠিত ‘আংরেজি হটাও’ সম্মেলনে জাপানি ভাষা নিয়ে তিনি বলেন, “আমাদের ভারতীয় ভাষাগুলোর তুলনায় জাপানি ভাষার কতগুলো অসুবিধা আছে। যাঁরা একটু খবর রাখেন তাঁরাই তা জানেন। একটা অসুবিধা হল এই যে, আমাদের যেমন অল্পসংখ্যক অক্ষর দ্বারাই সব বাক্য লেখাও যায়, বইতেও ছাপানো যায়, জাপানি ভাষাতে সে ব্যবস্থা নেই। আছে নিজেদের অক্ষর এবং চৈনিক অক্ষর প্রায় হাজার তিনেক। যাঁরা উচ্চশিক্ষায় ইচ্ছুক তাঁদের এ সবকটাকেই শিখতে হয়। এর জন্য আমাদের দেশের যেখানে মাতৃভাষা বছরখানেক বা বছর দুয়েকের মধ্যে চলনসই আয়ত্তের মধ্যে এসে যায়, ছেলেমেয়েদের সেখানে জাপানি ভাষা শিখতে গড়ে লাগে প্রায় ছয় বছর। এত অসুবিধা সত্ত্বেও এমন অবস্থা জাপানি ভাষার যে প্রত্যেক জাপানি বিজ্ঞানী, জাপানি দার্শনিক নিজেদের মনের প্রত্যেকটি কথা জাপানিতে প্রকাশ করতে পারেন। এতে সুবিধা হয়েছে এই যে, দেশের মধ্যে বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা যখন চালু হয়েছিল তখন তার জন্য শিক্ষক পাবার কোনও অসুবিধা হয়নি, -এমন শিক্ষক যিনি জাপানি ভাষায় বিজ্ঞান কিংবা দর্শন কিংবা অন্যান্য কলাবিদ্যা আয়ত্ত করে নিয়েছেন ও পড়াতে পারেন”। জাপানি ভাষায় যদি বিজ্ঞানচর্চা এতটা উন্নত হতে পারে, তাহলে বাংলাতেও তা অসম্ভব নয়, এমনই ছিল সত্যেন্দ্রনাথের মত।
বাংলা ভাষায় বিজ্ঞানচর্চাকে শক্ত ভিতের ওপর দাঁড় করাতে সত্যেন্দ্রনাথ সারা জীবন কঠোর পরিশ্রম করে গিয়েছেন। সেই উদ্দেশ্যে ‘বিজ্ঞান পরিচয়’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন তিনি। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ। স্বাধীন ভারতে বৈজ্ঞানিক গবেষণার অন্যতম পথপ্রদর্শক হয়ে ওঠে এই প্রতিষ্ঠান। বঙ্গীয় বিজ্ঞান পরিষদ থেকে ‘জ্ঞান ও বিজ্ঞান’ নামে একটি পত্রিকা চালু হয় সত্যেন্দ্রনাথের উদ্যোগে। পাশাপাশি, এখান থেকে বিজ্ঞানের নানা রকমের গবেষণামূলক বই প্রকাশিত হতে থাকে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বিজ্ঞান নিয়ে লেখা নিজের বই ‘বিশ্বপরিচয়’ উৎসর্গ করেছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ বসুকে।
তথ্যঋণ - ড. সুমিত্রা চৌধুরী, মুনির হাসান, সুব্রত বড়ুয়া, মোহম্মদ সইফুল ইসলাম।