No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    ‘ভরপেট নাও খাই/ রাজকর দেওয়া চাই’ – হীরক রাজার সেকাল ও একাল

    ‘ভরপেট নাও খাই/ রাজকর দেওয়া চাই’ – হীরক রাজার সেকাল ও একাল

    Story image

    হীরক রাজ্যের সেই ফজল মিঞা’কে মনে আছে? যে বলেছিল— 'মহারাজ আপনিই মোদের বাপ-মা, একটু বিবেচনা করেন, নইলে তো না খেতে পেয়ে মরে যাব।’ আর রাজবিবেচনা কী বলেছিল? ‘ভরপেট নাও খাই/ রাজকর দেওয়া চাই… যায় যদি যাক প্রাণ/ হীরকের রাজা ভগবান’। হতভম্ব হয়ে যাওয়া ফজল মিঞা’, তার আধপেটা খাওয়া অস্বিত্বটা ‘মগজধোলাই’ হতে যন্তরমন্তরে ঢুকে যাওয়ার আগে অব্দি আর্তনাদ করেছে— তার ‘রক্ষাকর্তা’ রাজার কাছেই! মা-বাপ জ্ঞানে বিশ্বাস করা রাজা নিশ্চয়ই তাকে রক্ষা করবে, ফজল মিঞা’র বিশ্বাস ছিল। মহারাজ ততক্ষণে বধির। গভীর রাজকার্যে মন দিয়েছেন। ‘যন্তরমন্তর’ ফজল মিঞা’র নির্ভুল ‘মগজধোলাই’ করতে পারে কিনা, সেটাই তখন রাজচিন্তার একমাত্র জরুরি বিষয়।

    রাজার তথা ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্রের এই বধিরতা উঠতে বসতে সহ্য করে যেতে হয়। দাঁতে দাঁত চেপে। যে বধিরতা কাতারে কাতারে মানুষ অক্সিজেনের অভাবে খাবি খেয়ে মরলে কাটে না। গণচিতা জ্বললে কাটে না। কুকুর শকুনে লাশ ছিঁড়ে খেলে কাটে না। নার্সিংহোম হসপিটালে বেড না পেয়ে রাস্তায়, ফুটপাতে ধুঁকতে ধুঁকতে মরে গিয়ে লাশের স্তূপ জমে উঠলেও কাটে না। কাটে, যদি ভোট আসে। তখন বধিরতা ভেঙে হাজার নাকি লাখো, প্রতিশ্রুতি ওড়ে। ভোট যায়, হোর্ডিং ব্যানারসহ প্রতিশ্রুতিও নেমে যায়। গদি না বাঁচলে রাজাও বাঁচে না। তাই যেনতেন প্রকারেণ তিনি ‘গদিধর্ম’ পালন করেন। যখন শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার কথা পরস্পরের থেকে, তিনি ঘেঁষাঘেঁষি করে লাগাতার মাসাধিককাল জুড়ে সভা করেন। লক্ষ লক্ষ মানুষকে ইনফেক্টেড করেন। লক্ষ লক্ষ মানুষ আরও লক্ষ মানুষকে। আমরা আগেই জেনেছি, ফজল মিঞাদের জীবন যেহেতু রাজার তরে, অভিযোগ তো সেখানে ‘রোগ’! অন্যদিকে দেশের মিডিয়া, গদি-মিডিয়া। কোথাও টুঁ-শব্দ নেই। হীরকরাজ হীরে নিয়ে ঘুরতেন মুখ বন্ধের নিমিত্ত। আসলে ফ্যাসিস্ট মাত্রেই হাজারও ভয়, তাই হীরে হোক বা টাকা, দেদার ওড়ে।    এদিকে ভোট যেতে না যেতেই মহামারী। হবুচন্দ্র রাজা আর গবুচন্দ্র মন্ত্রী যারা দু’বেলা ব্যক্তিগত জেট-প্লেন উড়িয়ে রাজ্যে ডেলি-প্যাসেঞ্জারি করত, পারিষদসহ খিল দেয়। মানুষ দিশেহারা। অক্সিজেন নেই, ওষুধ নেই, জীবনদায়ি ইঞ্জেকশন নেই। কার কাছে যাবে? সপারিষদ রাজা হয়তো মগ্ন নতুন রাজ(সংসদ) ভবন নির্মাণে কিংবা বিদেশ ভ্রমণের জন্য বোয়িং বিমান কেনার পরিকল্পনায়! রাজ সুরক্ষা সব সুরক্ষার আগে! মনে পড়ছে কিছু? ঠিক, ‘যায় যদি যাক প্রাণ/ হীরকের রাজা ভগবান’! সত্যজিৎ আসলে এক চরিত্রের কাঠামোয় সব দেশকালের ফ্যাসিস্টকে জায়গা করে দিয়েছেন।   অন্যদিকে ফজল মিঞা’দের সভায় না গিয়ে উপায় থাকে না। বিশেষত গ্রামাঞ্চলে বা ছোটো শহর বা শহরাঞ্চলে, চিহ্নিত হওয়া অনেক সোজা। আসলে এর চেয়েও বড়ো কারণ ফজল মিঞা’দের অতশত ভাবার ফুরসত কই? আধপেটার টানে টানে আর বাকি অর্ধেক পেট ভরবার স্বপ্নে তাঁদের দিনরাত্রি বারোমাস পার হয়ে যায়। ভরপেট খাবারের খোঁজে, নিদেনপক্ষে একটা টিফিনের প্যাকেটের জন্য সভা ভরে যায়। এই আমার দেশ। রাজাও বিলক্ষণ জানে। হীরকের রাজা তাই ফরমান জারি করে সেপাই পাঠিয়ে পাঠশালা বন্ধ করে। কারণ ‘অন্ধকার’ই রাজার গদি বাঁচাবার বড়ো অস্ত্র। আমাদের রাজা যেন হীরকের ডামিটি। রাতের অন্ধকারে গুণ্ডা পাঠিয়ে লণ্ডভণ্ড করে—সেকালের পাঠশালা, একালের বিশ্ববিদ্যালয়। রবীন্দ্রনাথের লেখার উপর ফরমান জারির হুমকি আসে মুহূর্মুহূ। কেননা হীরকের রাজার মতোই আমাদের হবুচন্দ্র রাজা জানে—'এরা যত বেশি জানে, তত কম মানে’! ব্যক্তিস্বাতন্ত্র‍্য নয়, প্রতিভার স্ফুরণ নয়, রাজা চায় জোড়হাতে জো-হুজুর আনুগত্য। হীরকের রাজা তাই দু’ধারে পারিষদবর্গ থুড়ি মাথানাড়া কলের মতো সান্ত্রী পোষে। উপঢৌকন দিয়ে রাজকবি পোষে। আর ছায়ার মতো অশ্লীল বিদূষক লেপটে থাকে গায়ে। যার কাজই হল রাজবাক্যের ধুয়ো ধরে রাজমহিমা জাবর কাটা। রাজকবি, জনতার দেওয়া খাজনার সুবিধা নিয়ে জনতারই ‘মগজধোলাই’ শ্লোক রচনা করে, অন্ত্যমিলে। ঠিকই ধরেছেন, হীরকের রাজা আমাদেরও রাজা। হীরকের দেশ, আমাদেরও দেশ। ৪০ বছর আগে সত্যজিৎ আসলে টাইম মেশিনে ঘুরে দেখে ফেলেছিলেন আমাদের এই সময়েরই ছবি! আমাদের রাজাও এই জো-হুজুরের বাইরে কোনও স্বর শুনলেই হীরকরাজের মতোই ভাবে—এরা এখনও কথা বলতে সাহস পায়! লেখক, সাংবাদিক, সমাজসেবী একের পর এক খুন হতে থাকে।     

    সত্যজিৎ হীরকদেশের মূল আয়ুধ শিক্ষক উদয়নের একটা কথার মধ্যেই ভরে দিয়েছিলেন— প্রজাকে যদি মরতেই হয়, অনিষ্টকারী রাজার আদেশ মান্য করে মরার চেয়ে বরং তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে মরা ভালো! এই আয়ুধও সব দেশকালের। মৃত্যু হয়তো হবে, কিন্তু অনিষ্টকারী রাজাকে গদিচ্যুত করার দম ফুরোবে না! সত্যজিৎ এখানেই শুধু পরিচালক বা লেখক নন, চিন্তক ও সমাজ-সংস্কারকও বটে। তাঁর একশোতম জন্মদিনে তাঁকে পড়াটাই শ্রেষ্ঠ অভিজ্ঞতা। আসলে তিনি নিজেই এক আয়ুধ।  

     

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @