সত্যজিতের অনুরোধে সিনেমায় প্রথম গান গাইলেন ঠাকুর বাড়ির এই বউ

মানিকবাবুর ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ আর ঠাকুর বাড়ির মেয়ে তথা বউমা এবার মিলে মিশে একাকার হয়ে গেল। আমরা যখন ছবির চরিত্রাভিনেত্রী করুণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লিপে শুনি সেই প্রাণঢালা গান – ‘এ পরবাসে রবে কে’, তখন জানতেও পারি না যে এরই মধ্যে ঘটে গিয়েছে এক বিদুষীর ঘরোয়া পর্দার আড়াল থেকে চলচ্চিত্রের পর্দার অন্তরালে গান নিয়ে ফিরে আসার এক অম্ল-মধুর ঘটনা পরম্পরার কাহিনি।
জোড়াসাঁকো ঠাকুর বাড়ির বউ হয়ে অমিয়া যখন চলে গেলেন, তখন থেকেই বলতে গেলে তিনি চোখের আড়ালে নিজেকে সরিয়ে নিলেন। তার আগে পর্যন্ত ঠাকুর বাড়ির অন্য শরিকের মেয়ে হিসেবে বিবিধ অনুষ্ঠানে নাচে, গানে নাটকে কোথায় নেই অমিয়া। বলতে গেলে রবিদাদার ‘মায়ার খেলা’-র সূত্রেই তো ঠাকুর বাড়ির দু-পুলিয়া পাটে বউ হয়ে এলেন অমিয়া। কিন্তু প্রকাশ্যে অভিনয় কিম্বা গানে তাঁর স্বামীর আগ্রহ ছিল না বলে অন্তঃপুরের জীবনকে সাদরেই গ্রহণ করেছিলেন অমিয়া ঠাকুর। যদিও এই মেয়ে তাঁর বাবার আগ্রহে গান শিখেছিল বিষ্ণুপুর ঘরের গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তাছাড়া চিরকাল এমনটাই তো হয়েছে যে, হিন্দি ভাষার গান যখনই শুনতে ইচ্ছে করেছে, তখনই রবিদাদা তো ডেকে পাঠিয়েছেন অমিয়াকেই। গান পরিবেশনের অমন ধ্রুপদী চাল ওবাড়িতে আর ক’জনের ছিল, তা হাতে গুণে বলা যায়। ওদিকে ভেতরে ভেতরে শাশুড়ি-মা কিন্তু উৎসাহ দিয়ে গিয়েছেন অমিয়াকে গান করার জন্য। তাই গানের চর্চাটা হারিয়ে গেল না।
এসব কোনও খবরই অজানা ছিল না সত্যজিৎ রায়ের। তিনি চাইলেন তাঁর সিনেমায় রবীন্দ্রনাথের গানটিকে ঠাকুর বাড়ির আঙিনার সঙ্গে জুড়ে নিতে। তাই সটান হাজির হলেন অমিয়ার বাড়িতে। উদ্দেশ্য, ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ ছবির জন্য একটা গান চাই। খালি গলায় গাইতে হবে সে গান। সেই দৃশ্য তোলা হবে দার্জিলিঙের ম্যালে। এর আগে মাসতুতো বোনেরা মানে লীলা দেশাই, মনিকা দেশাইরা অনেকবার অনুরোধ করলেও ফিল্মে কণ্ঠ দেওয়ার ব্যাপারে নিজেকে সরিয়েই রেখেছিলেন অমিয়া ঠাকুর। এই বোনেরাও ছিলেন হিন্দি ছবি জগতের দুরন্ত অভিনেত্রী। কিন্তু এবার গড়পাড়ের সুকুমার বাবুর ছেলেকে ফেরালেন না অমিয়া। মনে মনে ভাবলেন রবিদাদার গান কত নাটকেই তো গেয়েছেন ঘরোয়াভাবে। তাহলে ছবিতেই বা নয় কেন? তাও, আবার এটা যখন মানিকবাবুর ইচ্ছে, তাঁকে ফেরানোটা কোনও কাজের কথা নয়। তাই এবার দীর্ঘদিনের আঁকড়ে থাকা সিদ্ধান্তটিকে এক লহমায় বদলে নিলেন তিনি। ঠাকুর বাড়ির বউ গান গাইলেন সিনেমায়। বিরক্তও হলেন না সিনেমায় গান দেওয়ার সময়ে ‘এখানে থামুন, ‘আবার করুন’ ইত্যাদি হঠাৎ হঠাৎ নির্দেশের জন্য। দরদ ঢেলে গানটি খালি গলায় গাইলেন পর্দার অন্তরালে, গৃহ-পর্দার আড়াল থেকে বেড়িয়ে এসে। তৈরি হল একটি ঐতিহাসিক দৃশ্য, সঙ্গে গান, ‘এ পরবাসে রবে কে’...