হাবড়া ও শান্তিপুরে তৈরি কচুরিপানার শাড়ি বাড়াবে কর্মসংস্থান, কমাবে জলদূষণ

দূষণমুক্তির সঙ্গে থাকুন, দূষণের সঙ্গে নয়
“Be a part of the solution, not part of the pollution”
গোটা বাংলায় বোধহয় এমন একজন মানুষকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যিনি কচুরিপানা দেখেননি বা চেনেন না। এই বহুবর্ষজীবী, ভাসমান জলজ উদ্ভিদটির আদি বাসস্থান দক্ষিণ আমেরিকা। তবে এখন একে আন্টার্কটিকা ছাড়া বাকি সব মহাদেশেই দেখতে পাওয়া যায়। মানুষের হাত ধরে, উনবিংশ শতক শেষ হওয়ার আগেই কচুরিপানা ছড়িয়ে পড়েছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া, মিশর, জাভা প্রভৃতি দেশে। কচুরিপানা খুব দ্রুতহারে বংশবৃদ্ধি করে এবং সমগ্র জলাশয়ের উপর ঘন আচ্ছাদন সৃষ্টি করে। এদের বংশবৃদ্ধির ফলে অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ বেড়ে ওঠার জায়গা পায় না, জলে অক্সিজেনের মাত্রা কমে যায়, যার ফলে মাছেদের জীবনধারণে প্রতিকূলতার সৃষ্টি হয়। এছাড়া, কচুরিপানা যুক্ত জলাভূমি হলো মশার বংশবৃদ্ধির আদর্শ স্থান। জলে কচুরিপানার পরিমাণ খুব বেড়ে গেলে নদীপ্রবাহে বাধা পড়ে, নদীপথে যাতায়াতে সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাঁধের মুখ আটকে যায়, মৎসজীবীরাও সমস্যায় পড়েন।
বিজ্ঞানী ও গবেষকরা দূষণের এই মাধ্যমকে মানুষের উপকারে লাগানোর চেষ্টা করছেন বহুদিন ধরেই। কচুরিপানার সাহায্যে আবর্জনাযুক্ত জলকে বর্জ্যমুক্ত করার বিভিন্ন প্রকল্প সাফল্যের মুখ দেখেছে। এই উদ্যোগগুলি খুবই কম খরচে কার্যকর করা সম্ভব। এছাড়াও, কচুরিপানাকে ব্যবহার করে বায়োডিজেল, সার প্রভৃতি তৈরির উদ্যোগ সৃষ্টি করেছে কর্মসংস্থানের। সম্প্রতি এই দেশে নজর কেড়েছে কচুরিপানার আরও একটি ব্যবহার। সৌজন্যে স্বচ্ছ্বতা পুকারে সংস্থা এবং নেচারক্রাফট সংস্থা। তাঁরা উদ্যোগ নিয়েছেন কচুরিপানা থেকে শাড়ি তৈরি করার।
স্বচ্ছ্বতা পুকারে সংস্থাটি প্রধানত লিঙ্গসাম্য এবং নারী ক্ষমতায়নের বিভিন্ন সামাজিক আঙ্গিকে কাজ করে। বিভিন্ন প্রকল্পের মাধ্যমে মহিলাদের সামাজিক সুরক্ষা দেয় এবং তাঁদের আর্থিক ভাবে স্বাবলম্বী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। এই এনজিও সংস্থাটি ইতিমধ্যেই টাটা মেটালিকস লিমিটেড-এর সাহায্যে খড়গপুরের প্রান্তিক মহিলাদের হাতের কাজে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। তাঁরা কচুরিপানা দিয়ে বিভিন্ন ব্যবহার্য সামগ্রী, যেমন- কাগজ, নোটবুক, ব্যাগ, পাপোশ, বাস্কেট, ঘর সাজানোর জিনিস তৈরি করেন এবং বাজারে বিক্রি করেন। এই কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি প্রকল্পের মাধ্যমে তাঁরা আর্থিক স্বচ্ছ্বলতার স্বাদ পাচ্ছেন। এবার সংস্থাটি উদ্যোগ নিয়েছে শাড়ি তৈরির।
কচুরিপানা থেকে ফাইবার নিষ্কাশনের পরিকল্পনাটি প্রথম মাথায় আসে হাওড়ার ভূমিপুত্র, উদ্যোগপতি ও স্বচ্ছ্বতা পুকারে সংস্থার অধিকর্তা আনন্দ গোবিন্দের। তিনি এনভায়রনমেন্ট ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিগ্রীপ্রাপ্ত। আনন্দ গোবিন্দ, কচুরিপানার কাণ্ড থেকে ফাইবার নিষ্কাশনের একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেন, যে ফাইবার দিয়ে শাড়ি তৈরি করা যায়। শাড়িগুলিকে এই উৎসবের মরশুমেই বাজারে আনার পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। সংস্থার ম্যানেজার কৌশিক মণ্ডল শাড়ি তৈরির প্রকল্পটি দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন। তিনি হাবড়ার কামদেব কাঠি অঞ্চল থেকে ২০০ জন মহিলাকে বেছে নিয়েছেন, যাঁরা উত্তর চব্বিশ পরগণার বনগাঁ থেকে মছলন্দপুর এলাকার ৩৫টি পুকুর থেকে নিয়মিতভাবে কচুরিপানা সংগ্রহ করেন। মহিলাদের একাধিক গোষ্ঠী কচুরিপানা থেকে ফাইবার বা আঁশ নিষ্কাশন করেন। পাটগাছ থেকে যেভাবে পাটের আঁশ বার করা হয়, এই পদ্ধতিটি অনেকটা তেমনই। কচুরিপানাগুলিকে কিছুদিন রোদে শুকানো হয়। তারপর তাদের থেকে আঁশ বার করে সুতো বানানো হয়। ১৫ জন মহিলা সুতো তৈরির কাজের সঙ্গে যুক্ত আছেন। এই সুতোগুলির সঙ্গে সুতি মেশানো হয়, তারপর রং করা হয়। সুতো বুনে এরপর তৈরি হয় ফিউশন স্টাইলের শাড়ি। শাড়িগুলি হাবড়া ছাড়াও তৈরি হচ্ছে নদিয়া জেলার শান্তিপুরে, যে অঞ্চল তাঁতের শাড়ির জন্য প্রসিদ্ধ। বিশেষজ্ঞদের মতে, শাড়িগুলি ক্রেতাদের কাছে অত্যন্ত আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে। শাড়িগুলির বাজারদর রাখা হবে সাধারণের নাগালের মধ্যেই।
রঙবেরঙের ১০০০টি শাড়ি ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে গিয়েছে এবং সেগুলিকে বিভিন্ন মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মধ্যে বণ্টনও করে দেওয়া হয়েছে। তাঁরাও শাড়িগুলিকে নিয়ে খুবই আগ্রহ দেখাচ্ছেন। তাঁদের কথায়, এই শাড়িগুলি চলতি সুতির শাড়ির থেকে নরম ও আরামদায়ক। তাঁদের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ছে কচুরিপানার শাড়ি-র কথা। এগুলির জন্য অর্ডার আসতেও শুরু করেছে।
কচুরিপানা জল থেকে তুলে শাড়ি বানানোর ফলে একদিকে যেমন কমছে জলদূষণ, অন্যদিকে বাড়ছে কর্মসংস্থানের সুযোগ। শাড়িগুলির বাণিজ্যিক উৎপাদন পুরোমাত্রায় চালু হলে প্রান্তিক মহিলারা এর মাধ্যমে মাসে চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা রোজগার করতে পারবেন।