পাজি ‘সঙের দল’ আর সেকেলে কলকাতা

“বারোয়ারি তলা লোকারণ্য হয়ে উঠল-- একদিকে কাটগড়া ঘেরা মাটির সং-- অন্যদিকে নানারকম পোশাক পরা কাটগড়ার ধারে ও মধ্যে জ্যান্ত সং। বড়ো মানুষরা ট্যাসলওয়ালা টুপি, চাপকান, পেটি ও ইষ্টিকে চালচিত্রের অসুর হতেও বেয়াড়া দেখাচ্ছেন।” (হুতোম প্যাঁচার নকশা)
আজব জিনিস বটে এই সং। বিদঘুটে সাজ আর বিদঘুটে অঙ্গভঙ্গি। আর তাতেই পেটে খিল ধরত দর্শকের। কিন্তু শুধুই কি হাসি? ঘামও ছুটিয়ে দিত সে মাঝেমধ্যে। শহরের বাবুদের নানান কুকম্মের খবর আর তাই নিয়ে রঙ্গরসিকতায় সঙের চেয়ে দর কেউ ছিল না। তাই একবার সং ঠেকাতে শহরে ব্রাহ্ম-ব্রাহ্মণ-খ্রিস্টান জোট বাঁধল। মিটিং হল। অশ্লীলতা ঠেকাও কমিটি হল। অবশ্য তাতে সঙের দল থুরি বাবুদের কথায় ‘অশ্লীলতা’ জিতে গিয়েছিল।
আজকের যুগে মিম দেখতে আমরা বেশ অভ্যস্ত। মিমের খারাপ-ভালো দুই-ই থাকে। আমরা আমাদের হিসেব মতো বুঝে নিই, কোন মিম উপাদেয়, আর কোনটি ‘অশ্লীল’। তা এই মিম খানিক অন্য আকারে আজ থেকে দেড়শো দুশো বছর আগেও ছিল। যাকে বলে জীবন্ত মিম। তখন তার নাম ছিল সং। কলকাতার গায়ে শহরের রং লাগতে শুরু করার পরেও বেশ কিছুকাল ছিল সঙের দৌরাত্ম্য।
একদিনেই তো আর এমন দশাসই শহর হয়নি কলকাতা। একটু একটু করে, পলি ফেলে তার গ্রামীন সাজগোজ মুছে ফেলা হয়েছে। সেই শুরুর দিকের শহরে সং ছিল স্বমহিমায়।
আরও পড়ুন
কলকাতার হারিয়ে যাওয়া ‘ঝিলিমিলি জানলা’
সেই সময় যে কোনো উৎসবে সং থাকতই। বিশেষ করে চৈত্র সংক্রান্তির দিন, গাজনের মেলায়, স্নানযাত্রায়, বারোয়ারি পুজোয়। হুতোম জানাচ্ছেন, চুঁচড়োতে বোম্বাচাক আর আচাভো-- এই দুটি সং বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। এখানে অত উন্নতমানের সং না থাকায় লোকের আক্ষেপও ছিল। কলকাতায় সং সাজত জেলে কাঁসারি মুচিরা। কাঁসারীপাড়া, জেলেপাড়ার সং দেখতে থিকথিকে ভিড় জমত। সেনেট হলের মস্ত সিঁড়িতে লোকে জমা হত, রীতিমতো মিছিল হত এই সংকে ঘিরে।
‘নিচুতলা’র যাপনে উঁচুতলার লোকের আগ্রহ কিন্তু কম ছিল না সেদিন। ফেরিওয়ালা, দর্জি, মুদ্দোফরাশ, ভিস্তিওয়ালা, খানসামা, হুঁকোবরদার, জেলে, মুচি, কাঁসারি-- সব মিলিয়ে ছিল শহর কলকাতা। ফলে, পুরোনো কলকাতার ইতিহাস মানে কিন্তু শুধু বাবুদের বাবুয়ানির ইতিবৃত্ত নয়। হ্যাঁ, তবে বাবুরাও স্বতোপ্রণোদিত হয়ে সঙের ব্যবস্থা করতেন বিভিন্ন উৎসবে। তার অন্যতম কারণ ছিল, অন্য বাবুদের কেচ্ছার খবর নেওয়া। তাদের ব্যঙ্গ করা। সং শিল্পের এটিই ছিল সারাৎসার। কলকাতার বাবুরা কেউ ইংরেজদের সঙ্গে দোস্তি করে, কেউ গোপনে হিন্দু, প্রকাশ্যে ব্রাহ্ম, কারো বা চরিত্রে দোষ-- সব খবর পাওয়া যেত সঙের কাছে। তথ্যপ্রমাণসহ যা বলা যাচ্ছে না, অথচ আঁচ করা যাচ্ছে বেশ-- তাই নিয়ে লাগিয়ে দাও সং। সত্য বলার এটিও এক শিল্প বৈকি।
যেমন কেশবচন্দ্র সেন নিজে ঘোষণা করেছিলেন, মেয়েদের বিবাহের ন্যূনতম বয়স হবে চোদ্দ। আর তিনি নিজেই তাঁর কন্যাকে বাল্যাবস্থায় বিবাহ দিয়েছিলেন কোচবিহারের রাজপুত্রের সঙ্গে। তাতে কৈশবীরা যতই যুক্তি দেখান না কেন, সঙের দল ঠিক বুঝেছিল, রাজপরিবারের সঙ্গলাভ এই বিবাহের অন্যতম কারণ। এই ঘটনাকে ঘিরে সঙের গান মারাত্মক প্রভাবও ফেলেছিল জনমানসে। সং কিন্তু তার শিল্পচর্চায় কাউকেই বাদ দিত না। স্বনামধন্যদের নিয়ে ব্যঙ্গ করতে বুক কাঁপত না তার।
তাই এই স্বনামধন্যরা একদিন বেজায় রেগে গেলেন। সংকে তারা বললেন ‘অশ্লীল’। হিন্দু- ব্রাহ্ম- খ্রিস্টান জোট বেঁধে ফেলল। কালীকৃষ্ণ দেব, কেশবচন্দ্র সেন, রেভারেন্ড কালীচরণ বন্দ্যোপাধ্যায় একযোগ হলেন সং ঠেকাতে। সং, থিয়েটার ইত্যাদিতে অশ্লীলতা ঠেকাতে ১৮৭৩ সালের ২০ সেপ্টেম্বর টাউন হলে তৈরি হল—‘অশ্লীলতা নিবারণী সভা’ বা ‘Society for the Suppression of Public Obscenity’। এর ফলেই কিনা কে জানে, পুলিশ কমিশনার স্টুয়ার্ট হগ ১৮৭৪ সালে চড়কের সং বন্ধ করার ব্যবস্থা করলেন। কিন্তু কাঁসারীদের নেতা কৃষ্ণদাস পালের নেতৃত্বে তা আর হল না। অর্থাৎ সং বজায় থাকল। আর, কলকাতার বাবুসমাজকে ট্রিগার করে ফের বেরোল নতুন গান—
“শহরে এক নতুন হুজুগ উঠেছে রে ভাই
অশ্লীলতা শব্দ মোরা আগে শুনি নাই;
এর বিদ্যাসাগর জন্মদাতা
বঙ্গদর্শন এদের নেতা
এদের কথার মাত্রা অশ্লীলতা
সদা দেখতে পাই;
কারে বলে অশ্লীলতা
লেজ তুলে দেখা নাই...”
উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকেই অমৃতলাল বসু, রূপচাঁদ পক্ষী, শরৎচন্দ্র দাদাঠাকুরের মতো বিখ্যাত মানুষরাই কিন্তু কথা জোগাতেন সঙের মুখে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশিকা পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁস হতেও সং বেরোল— “বিদ্যার মন্দিরে এ সিঁদ কেটেছে কোন চোরে / সখীরা নেকি নাকি পড়ল ফাঁকি / কেউ দেখেনি ঘুমের ঘোরে / বিদ্যা সর্ববিদ্যা অধিকারী / দেবের প্রসাদে গুমোর গো ভারী / বিদ্যা নিত্য পূজে আশুতোষে”। আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কেও ছাড় দেয়নি সং। আবার,মেয়েদের জন্য পর্দাপার্ক তৈরি হল-- তাতেও সং বেরোল। কোনো ইস্যু ছাড়া নেই। ব্রেকিং নিউজের মতো ছড়িয়ে পড়ত সং।
সঙের এটি একটি সুবিধে ছিল। নথিভুক্ত না করেও অনেক সত্য সে বলতে পারত। তবে এই সবকিছুকে নথিভুক্ত করাটিও তো একটি ঔপনিবেশিক ঘরানা। যার কবল থেকে আমরা আজও মুক্ত নই।
সঙের মধ্যে হয়তো বাস্তবিকই কিছু ‘অশ্লীলতা’ থাকত। যেমন, ১৮২৫-এর ৫ই ফেব্রুয়ারি সরস্বতী পুজোর বিসর্জনে মূর্তিকে ঘিরেই নাকি এমন অঙ্গভঙ্গি করা হয়েছিল, যে তাতে পঞ্চাশ টাকা জরিমানা দিতে হয়েছিল সঙের দলকে।
তবে এই উপাদানটি যে আমাদের প্রাচীন পুরাণে, শাস্ত্রেও একেবারেই ছিল না, তা নয়। কিন্তু, তখনো ‘অশ্লীলতা’ নামক ধারণাটির জন্ম হয়নি।
কলকাতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে যখন উপনিবেশের কাঠামো দৃঢ়ভাবে বসতে থাকল, তখন থেকেই তার পুরোনো সবকিছুকেই বাতিল করার চেষ্টা চলল। হয়তো তাতে ‘আধুনিকতা’র কিছুটা হাওয়াও এল। কিন্তু, সমস্ত চেতনা জুড়েই উপনিবেশ নির্মাণের ফলে কোনোকিছুরই আর হিসেব মেলাতে পারলাম না আমরা। তাই সংও বাদ গেল। নিচুতলার মানুষদের একটা কন্ঠস্বর বাদ গেল। শহরের দ্বিচারী বাবুদের বিরুদ্ধে এভাবে তারা খানিক বারুদ উগরে দিত। কিন্তু, বাবুদের রুচিতে আঘাত লাগল তাতে। আঘাত লেগেছিল কিন্তু ইংরেজদেরও। কারণ শোনা যায়, অসহযোগ আন্দোলনে বড়ো ভূমিকা ছিল সঙের। অর্থাৎ উপনিবেশের কাঠামো, তার সংস্কৃতি, তার আইন আদালত, তার শিক্ষাব্যবস্থা-- সবকিছুকে নিয়েই প্রশ্ন করত সং। আর তাতেই ফাঁসির ব্যবস্থা হল এই সুপ্রাচীন ‘শিল্প’টির।