No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    মৃত্যুর সঙ্গে একান্ত কথাবার্তা

    মৃত্যুর সঙ্গে একান্ত কথাবার্তা

    Story image

    ‘আমার জন্মের সঙ্গে সঙ্গে আমার মৃত্যুরও জন্ম হয়’- বোধের এই ইশারা থেকেই কী হাইডেগার গড়ে তুলেছিলেন তাঁর ‘মৃত্যু’ দর্শন, যেখানে সত্তা মানেই মৃত্যু-অভিমুখীন ? মৃত্যু তাঁর নির্বাচিত জগত প্রকল্পে অনিবার্য সংগীতের মত বেজে উঠেছে বারবার, সত্তার একান্ত নিয়তি রূপেই নয়, মৃত্যুকে জেনে জগতকে জানার ভিতরেই তাঁর তাত্ত্বিক সংহতি। আর মৃত্যুকে সন্দেহ ও ঘৃণার চোখে সতত মাপতে মাপতে সত্তাকে নিরূপণ করেছেন আরেক অস্ত্বিবাদী সাঁত্রে। সূর্যাস্ত, নদী ও পানশালার তীব্রতায় নিজেকে পড়তে চায় সত্তা। সূর্যোদয় ও পাখিদের উল্লাসযাত্রার ভিতর যে পবিত্রতা আছে, সূর্যাস্ত ও ক্লান্ত ডানায় কুলায় ফিরে আসার ভিতর রয়েছে ততোধিক অসমাপ্তি, ক্লান্তি ও সন্দেহ। মৃত্যুকে জীবনক্লান্ত সত্তা প্রশ্ন করে, সন্দেহ করে, ঘৃণা করে, তার সঙ্গে খেলা করে, মৃত্যু মাখে, আয়ু খায়। এই সমর্পণের নেশা ও যৌনতাকে চাটতে চাটতে চলে রক্তাক্ত ভাস্করের অনির্মিত মূর্তিটিকে পাথর ছেনে খুঁজে ফেরার খেলা। আর সেই মৃত্যুচিন্তা যখন আত্মকে অতিক্রম করে আত্মজনে পৌঁছয়, বলা ভাল আত্মকে অন্তর্ভুক্ত করে আত্মীয়-য় পৌঁছয়, তখন সুরে, সংগীতে, ভাস্কর্যে, কবিতায় জন্ম নেয় অশ্রুলেখ, জন্ম নেয় শোকগাথা। পড়ছি রাহুল পুরকায়স্থের ‘সামান্য এলিজি’।

    যে যাত্রা শুরু হয় মৃত্যুর পর, যে যাত্রায় থেমে থাকা আছে কিয়ৎক্ষণ, কিন্তু থেমে যাওয়া নেই-‘অন্ধকারে হাঁটছে যে-পথ/ সে-পথ তোমার, সে-পথ তোমার/ অন্ধকারে, অন্ধকারে’।

    গণহত্যার পর কোনও জনপদে কখনও প্রশান্তি ফিরতে পারেনা, কেননা মগজ পুড়তে থাকে প্রজন্মান্তরে, নদীর জল প্রশ্ন ক’রে চলে, রক্ত মোছার দাগ...স্বপ্নের ভিতর কলোনি গড়ে তোলে মধ্যবিত্ত আলপনার ছলে। তারপর যে কোনও মুহূর্তে ফণা তুলে বিষ ঢালে ঘুমে। কিন্তু একী, আমার  পাঠ্যতো কিছু শোকগাথা যে গুলি নাকি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের স্মৃতিতে লেখা। তবে কেন জেগে উঠছে গণহত্যার স্মৃতি? তবে কী আততায়ী বিস্মরণের গর্ভে লাথি মারছে এই সব লাইন, যে ভুলতে চায়, নৈশ্চিন্তবোধের কম্বলের নিচে আশ্রয় নিয়ে আতুপুতু কাটাতে চায় জীবন, তাকে কী ক্যালাচ্ছে নিরন্তর? কেননা ধারাবাহিক ভুলে যাওয়ার নাম গণহত্যা, পিতৃহত্যা, ভাষাহত্যা। মৃত্যু অতিক্রান্ত বাবাকে লেখা চিঠি পড়ি, ‘ যদিও জেনেছে তারা একদিন পোড়া ধোঁয়া, একদিন সব/ গৃহকাজ ফেলে রেখে চলে গেছ অস্ত্র-অভিমুখে, অস্ত্রহীন/ দিন যায়, যেভাবে পেরিয়ে যায় সংঘটিত মরুরেখা, ধ্বক’। শেষ শব্দটি ‘ধ্বক’। এখানে এসে নতশির কিয়ৎক্ষণ বসি, মাংসের সংসারের সমস্ত প্রদীপ নিভিয়ে, বিনিদ্র।

    ‘কলোনিবাতাসে কিছু মায়া রয়ে গেল/ ও-মৃতমুখের বর্ণ রঙিন পরশ’।  এবার কিছু কথা হোক রাহুলতন্ত্র নিয়ে, হোক কিছু নিষ্ঠুর বোঝাপড়া। এই বোঝপড়া খানিকটা গায়ে পড়াগোছের। কবির ধরা পড়ে যাওয়ার ভয় থাকে, হয়তো ধরা পড়লে তৃপ্ত লাগে। আর পাঠক আমির লোভ লোল ও জিঘাংসা কবির নিরাভৃত অলংকার গুলিকে কুড়োতে কুড়োতে তন্ত্রে পৌঁছনো।  সন্দেহতত্ত্ব রাহুল কলোনির জানলা। জগতপ্রপঞ্চ তার কাছে রহস্যময়।  আয়ু, মৃত্যু, সম্পর্ক, যৌনতা, নেশা এবং সততই আত্মকে সন্দেহ করতে করতে হেঁটে চলা এই তন্ত্রের বৈশিষ্ট। আর আছে তামাশা, নিবিড় বায়সের মতো জাগতিক সমস্ত আয়োজনের ওপর খড়কুটো নিক্ষেপ করতে করতে রাহুলকলোনি এক নিষ্ঠুর আনন্দ উপভোগ করে। মাতাল মক্ষিক হয়ে জীবনকে চাটতে চাটতে, সত্তার রোমকূপে বমি করতে করতে পাঠককে উত্তেজিত, নেশাতুর, কামাতুর করে এক আশ্চর্য সুরের ভ্রমে বেঁধে ফেলতে সু-পারঙ্গম এই তন্ত্র। প্রতি মুহূর্তে সংকেত পাঠাতে পাঠাতে এই কলোনি যে কত পাঠকযাত্রীকে ভুল বাসে তুলে দেয় তার কোনও ইয়ত্তা নেই। পাঠকের মেধার শরীরের প্রতি এক আশ্চর্য অধিকার ও শাসন কায়েম না ক’রে রাহুলতন্ত্রের স্নায়বিক ইশারাতন্তু ক্লান্ত হয় না। আর এই সব আততায়ী কবিকর্ম ঘটে চলে ধ্রুপদী সংগীতের আবডালে।

    শক্তি চট্টোপাধ্যায়কে লিখছেন, ‘তোমার বাঁশির সুর অতলান্ত থেকে আসে ভেসে আসে/ এ-শহরে নেশারাতে, নেশাবিরতিতে/ দুলে ওঠে মহব্বত, বনরাজিনীলা-/ ও চাঁদ দিয়ো না দোলা, দিয়ো না দিয়ো না দোলা,/ ও চন্দ্র, সহিস সহিস,/ আমার প্রত্যঙ্গে বাড়ে বিষ,...।

    নাকে তুলো, চোখে তুলসীপাতা লাশকে চিনে নিতে এলিজি লাগে না, মৃত্যুর পর সত্তার সঙ্গে ব্যক্তিগত কথাবার্তার নৈতিক দায় থেকে জন্ম নেয় ‘সামান্য এলিজি’। প্রতিটি জীবন তন্ত্রকে পাঠ করতে করতে প্রণয়ভুক, আশ্রয়ক্ষুধার্ত এলিজি লেখক তাঁবু খাটান রহস্যের অক্ষরে। ছটি সুরখণ্ডে  উৎপলকুমার বসুকে পড়তে পড়তে ‘কালো মলাটের নীচে রাতের ইস্কুল, আমি পড়ি/ বৃষ্টিমাতা আর রাখালদাসেরে আমি পড়ি/ মাছের হাওলাদার, পুরানো জাঁতিটা আমি পড়ি/ সব পড়া দেখে চলি না দেখার মতো...’ ।  ‘ হেঁটে চলেছেন, মৃত্যুর পরেও তিনি হেঁটে চলেছেন/ যতদূর বাংলার কবিতা/ হাওয়ায় হাওয়ায় তাঁর সাদা পাতলুন, / ছোট্ট নোটবুক.../ প্রতিটি সীমানা ভেঙে একা একা উৎপলকুমার’।

    কবির মৃত্যুস্নাত এই ব্যক্তিগত আলপথে আপাতত শেষপ্রান্তে ভ্রমণরত ভূমেন্দ্র গুহ। মেডিকেল কলেজের এই এমসিএইচ, থোরাসিক সার্জারি বিভাগের প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাক্তন প্রধান অত্যন্ত প্রযত্নে, বিনা চিকিৎসায় নিজের শরীরে পুষে ছিলেন কর্কট। ‘ তুমি বিবসন শোনো অস্ত্রের আহ্বান-/শরীরে জাগাও মৃত্যু, উপভোগ করো, / পড়ো এই অন্ধকার, চেটেপুটে পড়ো’।

    কারা এসেছিল, বসেছিল তাঁর সাথে, এই কাফের টেবিলে? কী কথা হয়েছিল, কতটা নৈঃশব্দের ঘোর, কতটা আলো ছিল, উত্তাপ ছিল, সময়ের প্রহরীরা কিভাবে পুড়িয়েছে তাঁকে? প্রশ্নগুলো চেনা, আর উত্তর ‘সামান্য এলিজি’।

    ‘সামান্য এলিজি’, রাহুল পুরকায়স্থ, ভাষালিপি, ৩০ টাকা 

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @