‘লিটল’ হলেও ভাবনায় বৃহৎ, কলকাতা বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিনের বিক্রি ছক্কা হাঁকাচ্ছে

‘লিটল ম্যাগাজিন’ শব্দে যুগপৎ স্বপ্ন ও সংগ্রাম মিশে থাকে। এর কোনো বাংলা প্রতিশব্দ নেই। দেশ-কাল ছাড়িয়ে এর একটাই পরিচয়, লিটল ম্যাগাজিন। আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় তাই লিটল ম্যাগাজিনের জন্য নির্দিষ্ট ছাউনির পরিচয় ‘লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ান’ নামেই। এই নির্দিষ্ট স্থান ১-২-৩ হলগুলির চেয়ে কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। যদিও এখানে মূলত বাংলা লিটল ম্যাগাজিন থাকে, তবুও বাঙালি পাঠকের বইমেলার উত্তেজনাকে বুঝতে এই প্যাভিলিয়ান এক একক।
সাহিত্যের একটা বড়ো অংশ এই লিটল ম্যাগাজিনকে ঘিরে সচল। তাছাড়া সৃষ্টিশীল সাহিত্যের ক্ষেত্রে লিটল ম্যাগাজিনের কোনো বিকল্প নেই। সাহিত্যের ধারা বদল হয় এই ছোটো ছোটো পত্র-পত্রিকায়। নিয়ত হয়ে চলেছে। আজকের সাহিত্যের গতি কোন দিকে? কী ধরনের সাহিত্য লেখা হচ্ছে এখন? কোন কোন তরুণ লেখক সময়কে ধরতে পারছেন? এসব উত্তর একমাত্র দিতে পারে এই সব পত্রিকা।
আজকের সাহিত্যের গতি কোন দিকে? কী ধরনের সাহিত্য লেখা হচ্ছে এখন? কোন কোন তরুণ লেখক সময়কে ধরতে পারছেন? এসব উত্তর একমাত্র দিতে পারে এই সব পত্রিকা।
এমন যে ছোটো ছোটো পত্রিকার মধ্যে বিস্ফোরণের শক্তি থেকে যাচ্ছে তা বুঝতে লিটল ম্যাগাজিন হাতে নিতে হয়, পাতা ওল্টাতে হয়। কিন্তু এখন তো শুধু পত্রিকা নয়, তরুণ প্রজন্মের সম্ভাবনাময় স্বর চেনাতে খাওয়া-পরার টাকা লগ্নি করে বই ছাপাচ্ছে, কখনও একক, কখনও সিরিজে। খুব ক্লিশে শোনালেও এরকম সাহিত্যসেবাই সাহিত্যকে অনেকখানি ঠেলে দিচ্ছে সামনের দিকে। আগেও নতুন বই হত পত্রিকার তরফে, কিন্তু দিন দিন এই প্রবণতা বাড়ছে এবং তার ফল আশাপ্রদ। বহু নতুন মুখ, নতুন ধরনের লেখা, নতুন প্রজন্ম তৈরি হয়ে চলেছে - সাহিত্যের এই বহমান ধারার প্রধান স্রোত ছোটো পত্রিকা।
এবছর বইমেলায় প্রায় ২১২টি লিটল ম্যাগাজিন টেবিল। কলকাতার ম্যাগাজিন তবু হয়তো হাত বাড়ালে কলেজস্ট্রিটের ধ্যানবিন্দু-তে পাওয়া যাবে। কিন্তু উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পত্রিকার খোঁজ পেতে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ানের বিকল্প নেই। পত্রিকা আসছে আসাম থেকে, ত্রিপুরা থেকে। স্বপ্ন নিয়ে আসছে, সংগ্রামী কাজ ছড়িয়ে দিতে আসছে। কত অজানা লেখক, শিল্পী ছড়িয়ে আছে এক একটা টেবিলে। কত বিশেষ সংখ্যা চোখে পড়বে ব্যক্তিত্বদের নিয়ে, বিশেষ থিম নিয়ে। ‘নাটমন্দির’ নিয়ে বসেছেন রঞ্জন আচার্য, ‘শ্রমজীবী ভাষা’র কাজ নিয়ে আছেন একদল তরুণ, মাস্তুলের টেবিল আলো করে রয়েছেন তরুণ কবি-সম্পাদকরা, ‘স্বীকৃতি’, ‘স্যাফো’-র টেবিলে প্রান্তিক যৌনতা নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ, ‘দশমিক’-এর টেবিলে সদাহাস্য তরুণ পৃথ্বী বসু, সুস্নাত চৌধুরীর ‘বোধশব্দ’-র টেবিলে হাজির প্রবীর দাশগুপ্তকে নিয়ে ব্যতিক্রমী কাজ, ‘বিদুর’-এর টেবিলে আদি ও অকৃত্রিম অনন্য রায়ের কবিতা সংগ্রহ, ‘অনীক’ পত্রিকার নতুন সংখ্যা দেশভাগ ৭৫, অলোক সরকার ও দীপ্তি দাস সম্পাদনা করেছেন ‘তাবিক’-এর বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বিশেষ সংখ্যা, ‘কালি কলম ইজেল’-এর প্যারাফিলিয়া বিষয়ক গবেষণামূলক সংখ্যা বিকৃত যৌনতা। চোখ ধাঁধানো মানুষ আর সৎ-সাহসী মানুষদের অসামান্য সব কাজ নিয়ে ভরপুর লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়ন। বিষয়গুলো একইসঙ্গে ব্যাপ্ত ও গভীর। উল্লেখ্য, এ বছরই প্রথম লিটল ম্যাগাজিনে টেবিলের জন্য ৫৯০ টাকা করে ধার্য করে পাবলিশার্স ও বুকসেলার্স গিল্ড। ফলস্বরূপ গতবারের মতো প্যাভেলিয়ান আর দুইভাগে ভাঙেনি, আগের মতো এক তাঁবুতেই। এবং টেবিলের জায়গাও অনেকখানি বাড়ানো হয়েছে।
প্যাভেলিয়নে ঢুকলেই সবচেয়ে নজর কাড়ে পারস্পরিক বন্ধন। দুটো পত্রিকা হয়তো একটাই টেবিলে কিংবা কোনো পত্রিকা হয়তো টেবিল পায়নি স্থানাভাবের দরুণ, সেখানে অন্য একটা টেবিলে তারা দিয়ে যাচ্ছে বিক্রির জন্য। এই বোঝাপড়া সত্যিই লিটল ম্যাগাজিনের প্রাণ। প্যাভেলিয়নে তাই সর্বদাই ধ্বনিত হচ্ছে ঐকতান। বহু মূল্যবান পুরোনো সংখ্যা খুঁজতে আসছে অনেকে। সে সংখ্যা হয়তো আপনি আর কোথাও কিনতে পাবেন না, কিন্তু বইমেলায় সব পত্রিকাই নিজেদের যাবতীয় সম্ভার উঠিয়ে আনে বলেই থাকলে আপনার অভিপ্রেত পুরোনো সংখ্যা আপনিও পেয়ে যাবেন। হাঁটতে হাঁটতে চোখ আটকে যাবে পুরোনো কোনো বইয়ের উপর। আপনি হয়তো জানতেনই না আপনার প্রিয় লেখকের এ নামেও কোনো পুরোনো বই আছে। এই মজাগুলো, প্রাপ্তিগুলো প্যাভিলিয়ান আপনাকে দিতে পারে।
এবছর বইমেলায় প্রায় ২১২টি লিটল ম্যাগাজিন টেবিল। কলকাতার ম্যাগাজিন তবু হয়তো হাত বাড়ালে কলেজস্ট্রিটের ধ্যানবিন্দু-তে পাওয়া যাবে। কিন্তু উত্তরবঙ্গ, দক্ষিণবঙ্গের প্রত্যন্ত অঞ্চলের পত্রিকার খোঁজ পেতে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ানের বিকল্প নেই।
লিটল ম্যাগাজিন সংগ্রামের আর এক নাম দু’রকম ভাবে। একটা আলোচনা করা হয়েছে। যেটা অর্থনৈতিক সংগ্রাম। অন্যটা হল, সমকালীন রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় সমস্তরকম বিধিবদ্ধ সংকীর্ণতার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে যাচ্ছে ছোটো ছোটো ক্ষণস্থায়ী এরকম এক একটা পত্রিকা। বাঙালির প্রগ্রেসিভ চিন্তাভাবনার এক উৎসমুখ লিটল ম্যাগাজিন। প্রতিটা পত্রিকা ঘিরে এক একটা গোষ্ঠী। নতুন নতুন চিন্তায় সদাই উত্তেজিত এক একজন। সম্পাদকরা নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। ভালো লেখা নির্বাচনে, ভালো লেখককে তুলে ধরতে, ভালো ব্যক্তিত্বকে চেনাতে, ভালো বিষয়ে নজর ফেরাতে সম্পাদকদের দায়বদ্ধতা কুর্ণিশযোগ্য।
সমীক্ষা বলছে আন্তর্জাতিক কলকাতা বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভেলিয়নে বিক্রির সংখ্যা ক্রমশ ঊর্দ্ধমুখী। পাঠকরা নতুন লেখায় মগ্ন হচ্ছেন, আলোচনা করছেন। সৎ লেখক, সৎ সম্পাদক এবং সৎ পাঠক মিলিয়ে সাহিত্য সংস্কৃতির অগ্রগতির অঙ্গীকার নিয়ে বইমেলায় লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়ান স্বপ্ন-সংগ্রামে বসে আছে। আপনি এসে ঘুরুন, পাতা ওল্টান, কিনুন, স্বপ্নগুলো বাঁচিয়ে রাখুন, সংগ্রাম জিইয়ে রাখুন।