তালপাতার সেপাই

পুতুল, সে বড় আপনজন। সকল দেশের সবার মনের মানুষ। কথা কওয়ার বন্ধু। ওই যে ছোট্ট মেয়ে সেও সই পাতায় পুতুলের সঙ্গে। আবার অন্য রকমও হয়েছে কালের নিরিখে। যে কারণে বাংলার পুতুল মহল্লায় কাঠের পুতুল, মাটির পুতুলের বাইরে আরও পাওয়া যায় তাল পাতার পুতুল। না শিল্পী এখানে একটু অন্য কথার মানুষ। সে বানায় সাহেব মেমসাহেব, সে বানায় সেপাই। শুধু তাই নয়, এমন তার কায়দা কানুন যে তাকে হাতে নিয়েও নাচানো যাবে। এর ভেতর দিয়ে কি নতুন কোনও কথা বলতে চাইলেন শিল্পী?
ফিরে যাওয়া যাক এক আগুন মাখা অতীতে। বাংলায় তখন স্বরাজ বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। একের পর এক তরুণ তাজা প্রাণ অস্ত্র হাতে নেমেছে বিপ্লবে। মানুষের মন তখন স্বাধীনতা চায়। তার ভাবনায় তখন অন্য বাসনা। যে ভাবে সাহেবরা গোটা দেশের মানুষকে দু’আঙ্গুলে নিয়ে নাচায় বা অত্যাচার করে ঠিক তেমন ভাবেই সাহেবদের হাতে নাচানোর একটা ইচ্ছা মানুষের মনে বুরবুরি কাটতে থাকে। বাংলার ঘরের পুতুল শিল্পীও সেই ইচ্ছার উল্টো পথের পথিক নন। সেই ভাবনাকে আরও অনেকটা উসকে দিতে তাঁরা খুঁজে নিলেন একেবারেই হাল্কা পুল্কা একটি পুতুল বানানোর মাধ্যম। গাছ গাছালির দেশ বাংলা। শিল্পীর খুব একটা অসুবিধেও হল না একটা নয়া মাধ্যম খুঁজে নিতে। ওই যে তালগাছ ‘এক পায় দাঁড়িয়ে সব গাছ ছাড়িয়ে।’ এই গাছের পাতা দিয়েই তৈরি হবে পুতুল। কেবল চাই একটা কঞ্চি কাঠি আর সাথে মা বোনেদের কাঁথা কাপড় সেলাইয়ের টুকরো সুতো। এই সব উপকরণ দিয়েই তৈরি হল তালপাতার সেপাই, তৈরি হল সাহেব মেম। সাহেবের আবার কলার তোলা ফিরিঙ্গি পানা জামা। মূলত বর্ধমান জেলায় জন্ম নিলো এমন পুতুল। তার পর গাঁ-বাংলার অন্যান্য জেলাতেও শুরু হয়ে গেল এমন পুতুলের চল। আজও বর্ধমানের মদন দত্ত তাই হয়তো অকপটে বলে বসেন ‘সাহেব, সেপাই নাচিয়ে বেড়াই আজও কিন্তু মনের আঁশ মেটে না।’ ঠাকুরদার কাছে গল্প শুনেছেন গুপ্ত সমিতির ধুতি আর শার্ট পড়া যুবকরা গ্রামের মেলায় এসে খোঁজ করতেন তাল পাতার সেপাইয়ের।
আর অন্য দিকে পরাধীন ভারতের কলকাতার বারোয়ারী ক্লাবগুলোতে হতো বিরাষ্টমী মেলা। অনুশীলন সমিতির সন্তানরা লাঠি খেলা, ছুড়ি খেলা আর কুস্তি খেলা দেখাতেন পুজো মাঠে অষ্টমীর দিন। মেলা লাগতো সেই মাঠ জুড়ে। বাগবাজার বা সিমলে পাড়ায় সেদিন অন্য ব্যস্ততা। তারই মাঝে গ্রাম থেকে আসা পুতুল কারিগর বিক্রি করতেন তালপাতার সেপাই কিম্বা সাহেব পুতুল। বুড়ো থেকে শুরু করে খোকা-খুকু সকলেই মেতে উঠতেন সেপাই নাচানোর বা সাহেব নাচানোর পাগলাই ধূমে। গান শুরু হয়। ভয় কি মরণে......। তালপাতার পুতুলে সেদিন দেশ প্রেমের আগুন, তালপাতার সাহেব সেপাই।