ভিকু সিং, আমাদের একসাথে বুড়ো হওয়া হলো না...

প্রিয় বিক্রমদাদা,
আমরা যখন ষষ্ঠ শ্রেণি, তুমি তখন দশম। দুপুরে ক্লাস শেষ হলে আমাদের হোস্টেলের সামনে দিয়ে হলুদ পাঞ্জাবি সাদা পায়জামা, ঢিমেতালে সাইকেল চালিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে বাড়ি ফিরছ। আমি হঠাৎ দৌড়ে এসে, “ও বিক্রমদাদা, প্লিজ একটা গান শুনিয়ে যাও। নইলে যেতে নাহি দেব” বলে সাইকেল ধরে দাঁড় করালাম।
“উফ রোজ বিরক্ত করিস, খিদে পেয়েছে, বাড়ি যেতে দে” বলে কপট বিরক্তি। তারপর একটা পা প্যাডেল থেকে নামিয়ে একের পর এক “নিভৃত প্রাণের দেবতা”, “...তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি”..., “বাত নিকলেগি তো ফির দূর তলক জায়েগি”, “কৌন গলি গায়-ও শাম”...। আমার মল্লিকাবনে তখন প্রথম কলিটি ধরেছে কি ধরেনি, ছাতিমতলার বাগানবিলাস গাছের গোলাপি ছায়ার দিকে তাকিয়ে চোখ চিকচিক। যে যাই বলুক, তোমার মতন যে কেউ গায় না, তা বারো বছর বয়েসেই বুঝে গেছিলাম। রোজকার এই গানের আসর, তুমি সাইকেলে আমি তোমার সাইকেল ধরে দাঁড়িয়ে, তুমি গান শেখাও আমি টপাটপ তুলি। যেন চৈত্রশেষের হোস্টেলের গাছের টুপটুপ ঝরে পড়া তেঁতুল। কোঁচড়ে নিয়ে ঘরে ফিরে নুন, সর্ষের তেল, চিনি আর কাঁচা লঙ্কা দিয়ে মেখে বেশ সারাদুপুর একা একা খাওয়া যাবে। বন্ধুরা ডেকে যায়, “আই, খেতে চল”, কে শোনে কার কথা। তখন তো সবে আখর-ওয়ালা “মাঝেমাঝে তব দেখা পাই”-এর প্রথম স্তবক। আর “দূরে কোথায়”-এর “যেতে চায় কোন অচিনপুরে”র ঐখানটা এখনও ঠিকমতন গলায়, মনে, বসেনি! “কাঙাল পরান” গাওয়ার সময়েও প্রাণের কাঙালপনাটা ঝালিয়ে নিতে হবে, কিছুতেই তোমার মতন হচ্ছেনা। তারপর তো খাওয়া-দাওয়া।
যত বড়ো হলাম সেই গান দেওয়া নেওয়া একটা আশ্চর্য বন্ধুত্বে গড়ালো। সুখ দুঃখের প্রেম-অপ্রেমের কথা, আজেবাজে বকা। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তখন তোমাদের ক্লাস নেন বাংলা ডিপার্টমেন্টে। আমরা ইশকুলের চৌকাঠে। “আসলে কেউ বড়ো হয় না, বড়োর মতো দেখায়”, তুমি পড়ে শোনালে প্রথম, শক্তিদার পাঠ-করা নকল করে...। তুমি তখন নিজেও কবিতা লিখছ। “ছাতিমকে লেখা চিঠি”... শুনে বিস্মিত হয়ে এখনও মনে পড়ে গৌরপ্রাঙ্গনের গা দিয়ে সদ্য ফোটা টগরগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিলাম। “জ্বলে উঠুক সকল হুতাশ”-এর তখনও সময় আসেনি, কিন্তু তোমার গলায় শুনে মনে হয়েছিল, সেই সময় এলে আঘাত ঠিক সয়ে যাবে, যত কঠিন সুরেই জীবন-তার ঝংকৃত হোক না কেন, সামহাল লেঙ্গে হম।
শক্তি চট্টোপাধ্যায় তখন তোমাদের ক্লাস নেন বাংলা ডিপার্টমেন্টে। আমরা ইশকুলের চৌকাঠে। “আসলে কেউ বড়ো হয়না, বড়োর মতো দেখায়”, তুমি পড়ে শোনালে প্রথম, শক্তিদার পাঠ-করা নকল করে...। তুমি তখন নিজেও কবিতা লিখছ। “ছাতিমকে লেখা চিঠি”...
তারপর কলেজে উঠলে সেই আড্ডা পৌঁছলো নবদ্বীপদার দোকানে, যেমন সকলের পৌঁছতো সেই সময়ে। বিজ্ঞানে গবেষণারত অনির্বাণদা, তোমার প্রাণের সহচর হল। এইসব আড্ডায় জানলাম বিজ্ঞান পড়লেই যে কেউ সাহিত্য-সংগীতের রূপ ও রস বুঝবে না তার কোনো মানে নেই। একে একে জুটলো দেবাঙ্গন, সৌভিক-ছকাই, সুচিন্ত্য, শ্রেষ্ঠা, তৌফিক, মানসদা। আড্ডা বড়ো হলো। আমরা এক পূর্ণিমার আগের রাতে কোপাই নদীর ব্রিজের ওপর বসে তোমার কাছে শুনলাম, “কিছুই তো হলো না সেইসব সেইসব”। এক বন্ধু গিটার বাজালো সঙ্গে। তোমার হাতে সিগারেট একটা লম্বা ছাই-এর স্কাল্পচার হয়ে গেলো। এমন গানে বিভোর যে তুমি গানের মাঝে টানতেই ভুলে গেলে। তুমি ঠুংরি-গজল গাইতে বলে আমরা নাম দিলাম “ঝুমরিতালাইয়া-গজলগাইয়া”। তোমার হাত নেড়ে নেড়ে গান গাওয়া নকল করে তখন কত ঠাট্টা করতাম। কিন্তু এইসব ছেলেমানুষির মাঝেও জানতাম, তোমার মতন কেউ গায় না। আমাদের বাড়ির ঝুলবারান্দায় একদিন তোমাকেই শোনালাম তোমার শেখানো, “আমি বহুবাসনায় প্রাণপণে চাই, বঞ্চিত করে বাঁচালে মোরে”। তুমি বললে, “বাহ্ রে, কী পরিচ্ছন্ন গাইলি! কখনও গান রেকর্ড করলে এইটা অবশ্যই করিস কিন্তু।” আমি হাহা করে হেসে বলেছিলাম, “আমি? গান রেকর্ড করবো? তোমার কি মাথাটা আরো খারাপ হয়ে গেছে?” তুমি অজান্তেই জেনে গিয়েছিলে, একদিন আমি গান গাইবো, রেকর্ড করবো, আমার নিজের জানার বহু আগেই।
মোহনকাকুর রুপোলি কাইনেটিক হোন্ডা নিয়ে সন্ধেবেলা তুমি আড্ডায় আসতে। ওল্ড স্পাইস-এর ভুরভুরে গন্ধ। “দেখ ভালো না, গন্ধটা?” “উফ রোজ এক গন্ধ মেখে আমাদের শোঁকাও কেন, বলতো?” সুবর্ণরেখা হয়ে আসতে তোমার থেকে বয়েসে দ্বিগুণ ইন্দ্রকাকা, শিবদা, সুজিতদা, অরুণকাকা, আমার বাবা, কোকোকাকাদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে প্রায়ই একটা-দুটো নতুন বই নিয়ে। আমি বলতাম, “পারোও বটে প্রিটেনশাস বই পড়তে!” একদিন এসে বললে, “ওরে, তোর নামে আমাদের বাড়ির নাম দেওয়া হলো, কিন্তু তালব্য-শ-এ ‘শাহানা’, শুনতে ভালো লাগে।” আমি বললাম “ঢঙে আর পারা যায় না ভিকু, আমরা সবাই জানি ‘সাহানা’ তোমার প্রিয় রাগ।” তুমি স্বভাবতই হা-হা-হা করে হেসে উঠলে নবদ্বীপদার দোকান কাঁপিয়ে। ইন্টারনেট এল, রাজেনদাদের দোকান (জানো, এখন সেখানে ‘বইওয়ালা’ বলে একটা বইয়ের দোকান হয়েছে?) থেকে তোমার ইমেল আইডি খুলে দিলাম রেডিফ মেইলে। তোমার সে কি শিশুসুলভ উত্তেজনা। রতনপল্লিতে কোনো একটা বচসায় তুমি কাকে এক ঘা দিয়েছিলে রেগে গিয়ে, কোনো মহিলাকে উত্যক্ত করার প্রতিবাদে। বাবা দেখলাম তোমাকে খুব আশীর্বাদ করলেন – “যে এতো ভালো গান গায় তার এমন ফাইটিং স্পিরিট, ব্রাভো বিক্রম।”
একদিন এসে বললে, “ওরে, তোর নামে আমাদের বাড়ির নাম দেওয়া হলো, কিন্তু তালব্য-শ-এ ‘শাহানা’, শুনতে ভালো লাগে।” আমি বললাম “ঢঙে আর পারা যায় না ভিকু, আমরা সবাই জানি ‘সাহানা’ তোমার প্রিয় রাগ।”
এক বছর মন ভেঙেচুড়ে শান্তিনিকেতনে ফিরলাম, এক গলা অভিমান নিয়ে, লজ্জায় দিনের পর দিন বাড়ি থেকে বেরোই না যদি বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, ওরা আহা-উহু করে যদি। বাড়ি-বন্দি বসে থাকি আর সারাদিন মায়ের কাছে কাঁদি। একদিন ভোরে শুনি দোতলার জানলায় কেউ ঢিল ছুঁড়লো। জানলা খুলে দেখি উস্কখুস্ক চুল নিয়ে আড়াআড়ি ব্যাগ ঝুলিয়ে তুমি। “কী করছিস, ঘুমোসনি? আমি সারারাত ঘুমাইনি। চল কোপাই যাই চা খেয়ে আসি।” চা খাওয়া হলো। পুরোটা সময় একটা কথাও কেউ বললাম না মন-ভাঙাভাঙি নিয়ে। বাড়ি ফিরে মাকে বললে, “একটু মাখো মাখো করে আলু পোস্ত বানাও আর কলাইয়ের ডাল।” সারাদিন সিনেমা দেখলাম আমরা। এমন ভাব যেন কিছুই হয়নি কারুর। সব ঠিক আছে, আর না থাকলেও, হয়ে যাবে। ওই যে, কিশোরীবেলায়, সামহাল লেঙ্গে হম শিখিয়েছিলে!
ল্যান্ডলাইনের যুগ। ফোন করলে প্রায়ই শুনি তুমি চান করতে গেছো। পরে ফোন করে বলতে, “শোন না, আজ বেশ করে শ্যাম্পু দিয়ে চান করলাম।” আমি তাচ্ছিল্যে বলতাম, “ওই তো দুটো চুল, তার আবার শ্যাম্পু। তোমার বুড়োবয়েসে ইয়াব্বড়ো টাক পড়বেই দেখে নিও।” তার উত্তর প্রায়ই হতো, “আর তুই তাতে ছবি এঁকে দিবি কিন্তু! তবে বুড়ি হলে তোকে খুব সুন্দর দেখতে হবে। তুই একটা অতি সুন্দরী বুড়ি হবি, দেখিস।” তখনও আমরা নিশ্চিত, আমরা সকলেই একসঙ্গে বুড়োবুড়ি হবো। তখনও আমরা প্রবীরদার ধাবার পেছনে বসে ধানক্ষেতের ওপর চাঁদ-ওঠা দেখবো। তুমি গাইবে “তুমি কিছু নিয়ে যাও, বেদনা হতে বেদনে”, ঝিরিঝিরি হাওয়া দেবে, বৌদি মাছ-চুর ভেজে দিয়ে যাবে মাঝে মাঝেই, আমাদের বাড়ি ফেরার তাড়া থাকবে না তেমন।
ভিকু সিং, আমাদের একসাথে বুড়ো হওয়া হলো না। কিন্তু এই যে এতো গান, এতো প্রাণ ঢেলে, উদাত্ত গলায়, রসে-ভাবে কোনো খেদ না রেখে, অবলীলায় গেয়ে দিয়ে চলে গেলে, এরপর আমরা আর কী গাইবো বলো তো? কোনো মানে হয়? ধুর।
ইতি,
তোমার সাহানা
(যে বুড়ি বয়েসে আয়না দেখলেই মনে মনে ভেবে নেবে, “বাহ্ কী সুন্দরী বুড়ি!”)