সাবির’স হোটেল ও তার জাদু মাখা রেজালা

একটা সময় ছিল যখন আজকের মতন সব জায়গায় মোগলাই খানা পাওয়া যেত না পাড়ায় পাড়ায়। বিরিয়ানির দোকান, চপের দোকান, কাবাবের দোকান কলকাতার সব জায়গায় গড়ে ওঠেনি তখন। ওই সময় থেকেই পুরনো মোগলাই খানার ঠিকানাগুলোর মধ্যে লোকের মন জয় করে নিয়েছিল চাঁদনি চকের বিখ্যাত সাবির'স হোটেল। ধর্মপ্রাণ মুসলিম হাজি সাবির আলি ১৯৪৭ সালে চাঁদনি চকে চালু করেন এই রসনা তৃপ্তির আখড়া। এখন সেই হোটেলের মালিক মোহাম্মদ সাহিদ জামাল। হাজি সাবির আলির বংশধর ইনি। তখন হোটেলটি ছোটো ছিল আর রসুইখানা ছিল সামনের দিকে। প্রচুর সংখ্যক মানুষ, বিশেষ করে আফগানিস্তানের কাবুলিওয়ালাদের একটা প্রধান আড্ডার ঠেক এই সাবির হোটেল। আজও কলকাতায় কাবুলিওয়ালারা সকাল এবং সন্ধের খাবারের জন্য তাদের পছন্দের সাবির হোটেলে এসে ভিড় করেন।
‘রেজালা’ কথাটি শোনেননি এরকম খাদ্য রসিক মনে হয় নেই। মুঘল হেঁসেল থেকে এই খাবারটি ছড়িয়ে পড়েছিল দিকে দিকে। বিরিয়ানির রেসিপি যেমন পাল্টে গেছে জায়গায় জায়গায়, রেজালাও তাই। আমরা কলকাতায় যে রেজালা খাই তার ঘরানা কিন্তু অন্যান্য জায়গার থেকে আলাদা। কলকাতার এই নিজস্ব রেজালার তার আবিষ্কর্তা কিন্তু এই হাজি সাবির আলি। এই হোটেলেই তিনি বানিয়েছিলেন সেই জাদু মাখা খাবারটি। সাদা ঝোলের ঘি, পেঁয়াজ আর বিভিন্ন মসলা সহযোগে খাসির সিনার মাংস দিয়ে তৈরি হয় এই রেজালা। হলুদ ব্যবহার হয় না। থাকে শুকনো লঙ্কা। বহু দূর দূরান্ত থেকে এখানে খেতে আসেন অনেকে। নিয়মিত খেতে আসেন এমন কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, আগের মতন স্বাদ হয়তো নেই, কিন্তু দামের দিক দিয়ে সাবির হোটেলের খাবার এখনো অন্য জায়গা থেকে অনেকটা সস্তা। পরিবেশ সাধারণ, মুসলিম ঘরানার ছোয়া দেখা যায় হোটেলের ভিতর।
এখানে এলে শুধু একবার মাটন রেজালা, বিরিয়ানি চেখে দেখবেন, তাহলেই টের পাবেন এর জাদু। বিরিয়ানি এখানে খুব ঝরঝরে এবং রংহীন। দাম আয়ত্তের মধ্যে। দেড়শো থেকে দুশো টাকার মধ্যেই সব রকম প্লেট পাওয়া যায়। তার পাশাপাশি এদের শাহি টুকরা আর ফিরনিও যেন স্বর্গীয়। সম্প্রতি একটি কাউন্টার করা হয়েছে। কাবাব এবং রোল পাওয়া যায় সেখান থেকে। রমজান মাসে হালিমও পাওয়া যায় এই হোটেলে। অঞ্চলটি যেহেতু মুসলিম অধ্যুষিত, তাই বাড়িতে হালিম কিনে নেওয়ার জন্য লাইন পড়ে রমজান মাসে। ম্যানেজার মোহাম্মদ আলম খান জানালেন, এখন নতুন প্রজন্মের কাছে চাইনিজ খাবারের চাহিদা বেড়েছে, কিন্তু সাবির’স হোটেলের খাবারের স্বাদ যারা পেয়েছেন, তারা অবশ্যই মাঝেসাজে চলে আসবেনই। হোটেলের দোতলা শীততাপ নিয়ন্ত্রিত। পরিবারের সকলকে নিয়ে খাবার সুবিধা আছে। চাঁদনি অঞ্চলের ল্যান্ডমার্ক এই সাবির’স হোটেল। ধর্মতলা অঞ্চলে অনেক মোগলাই রেস্টুরেন্ট থাকা সত্ত্বেও, যারা পুরনো দিনের মানুষ, তারা এখনো সাবিরের খাবারের ওপরে ভরসা রাখেন। তাই, যারা চাঁদনির আসেপাশে বিভিন্ন কাজে আসেন, সময় সুযোগ মতো একবার অবশ্যই ঢুঁ মেরে যান তারা সাবির’স হোটেলে। সন্ধেবেলায় গরম রুটি সহযোগে রেজালা খাওয়ার স্মৃতি মনে থাকবে অনেকদিন।