আকবর দিলেন ‘রায়’, জাহাঙ্গীর দিলেন ‘চৌধুরী’ – ইতিহাসের পাতায় সাবর্ণ রায়চৌধুরী

সৃষ্টি হয়েছে। সবে সব সৃষ্টি হয়েছে। এবার একটু বিশ্রাম। ঠিক বিশ্রাম নয়। ধ্যানকল্প। অনন্তনিদ্রায় শায়িত নারায়ণ। ডান হাত কাত করে মাথায় ঠেকানো। মাথা তুললেই শ্বেষনাগের পাঁচ মাথা। দুলছে। নাভিপদ্ম একটু উপরে। ধান্যাসনে ব্রহ্মা স্মৃতি ঘাঁটছেন। কোথায় কী হল, না হল? মনে পড়েছে। সাবর্ণ কূল। নবম অব্দ। হ্যাঁ, এবার পরিষ্কার হয়েছে। উচ্চ বংশ। ধার্মিক। দান-ধ্যান করে। পরেও করবে। সাবর্ণি ঋষির গোত্র পেয়েছে। এবার বাড়ুক। সৌরাষ্ট্র থেকে গৌড়বঙ্গ। অনেকটা পথ। হাঁটুক।
কূলপুরুষদের আখ্যান। ফেলে দেওয়া যায় না। ফেলে দেওয়া হয়নি। কান্যকুব্জে পৌঁছেছিল আবেদন। রাজার কাছে রাজার আবেদন। মহারাজ চন্দ্রকেতু শুনলেন। গৌড়বঙ্গে বিশেষ যজ্ঞ। ব্রাহ্মণ প্রয়োজন। সেখানের সপ্তশতী ব্রাহ্মণগণ অপারগ। মহারাজ আদিশূরের চাই যজ্ঞ পারদর্শী বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ। রাজা ফেরালেন না রাজাকে। পাঁচ ব্রাহ্মণের ব্যবস্থা হল। রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ। সাগ্নিক। ঋষিপুত্র। শ্রী বেদগর্ভ, শ্রী দক্ষ, শ্রী ভট্টনারায়ণ, শ্রী হর্ষ এবং শ্রী ছন্দ (ছান্দড়)। রাজার সঙ্গে রওনা দিলেন। গৌড়মণ্ডলে।এই বেদগর্ভই সাবর্ণ গোত্রীয়। সৌভরির পুত্র। বয়স ছুঁয়েছে চল্লিশ। দক্ষিণা পেলেন বটগ্রাম। বর্ধিষ্ণু গ্রাম। এখন মালদহে। গঙ্গাতীরের বটরি। নতুন ঘর গড়লেন। পত্নী অম্বালিকার সঙ্গে। ভৃত্যও আছে একজন। বিশ্বামিত্র গোত্রীয় কালিদাস মিত্র। পরিবার রয়েছে তারও। সংসার হল সবার। সুখ হল কিনা কেউ জানলো না। কেউ বলল না। ভবিষ্যৎ নিয়ে মতান্তর হল। বিস্তর। ইতিহাস মিলল পুঁথিতে। পুঁথিই বেদগর্ভর প্রশস্তি করছে। ভাবা বৃহস্পতির ভেরাবল প্রশস্তি। রক্ষা করছে প্রভাসের ভদ্রকালী মন্দির। সৌরাষ্ট্রে। এখন সুরাট। এখন গুজরাটে। বঙ্গদেশ দেখার আগেই উপাধি জোটে বেদগর্ভের। ‘উপাধ্যায়’। এবং সোমনাথ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত। তবে বেশি দিন সইল না। পিতৃআজ্ঞা এসে পৌঁছল। রাজঅনুগ্রহ এলো সঙ্গ করে। অতএব অনির্বাজ্য বঙ্গদেশ। অপরিহার্য ভূসম্পত্তি। কেউ বলে সেটাও নাকি সহ্য হয়নি বেদগর্ভের। বঙ্গদেশে প্রতিষ্ঠার পরেও সোমনাথ প্রত্যাবর্তন। কারণ অজানা। ভবিষ্যৎ অনুমান নির্ভর। সোমনাথের উপর যবন আক্রমণ। এবং বেদগর্ভের অযাচিত মৃত্যু। ততদিনে উত্তরপুরুষ বেড়েছে।
পঞ্চদশ শতক। ইব্রাহিম লোদী পরাজিত। বাবুরের আফগান সেনা দিল্লি দখল করেছে। এবার মুঘল সালতানত গড়ে উঠবে। সেনাবাহিনী গড়ে উঠছে। ক্ষমতা বেড়ে উঠছে। একাধিক ভাগে সেনা নিয়োগ। পারদর্শিতা দেখে পদ। যেমন পেয়েছেন পাঁচু শক্তিখান। পাঠান বাহিনীর অশ্বারোহী বিভাগে। উঁচু পদ। দক্ষ সৈনিক। তাই ‘খান’ উপাধি। তবে তিনি আদ্যন্ত ব্রাহ্মণ। আসল নাম পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায়। বেদগর্ভের উত্তরসূরি। পেশার বদলে নামটাই বদলে গেছে। তবু বঙ্গে ফিরে এসেছেন। বিধাতার লিখন। বসবাস করেছেন। প্রাসাদ গড়েছেন হাভেলি শহরে। এখন হালিশহর। আবার উত্তরপুরুষরা ছড়িয়ে গেছে। উত্তরপাড়া, বিরাটি, বড়িশায়।সবে সপ্তদশ শতক এলো। বছর পাঁচেকের মাথায় দুঃসংবাদ। আকবর আর নেই। মহান আকবর। ভারত সম্রাট। জালালুদ্দিন মোহম্মদ। শেষ নিশ্বাস নিলেন ফতেপুর সিক্রিতে। গদি পেল সেলিম। নতুন সম্রাট। নতুন নাম। ‘জাহাঙ্গীর’। নতুন আশায় বুক বাঁধল হিন্দুস্থান। বাংলা পেল নতুন জায়গীরদার। রাজা মানসিংহ। বছর ঘুরতেই এলেন বঙ্গদর্শনে। অভ্যর্থনার ভার নিলেন লক্ষ্মীকান্ত। না, গঙ্গোপাধ্যায় নন। পদবী বদলেছে। পদবী যুক্ত হয়েছে। আকবর দিয়েছেন ‘রায়’। জাহাঙ্গীর দিলেন ‘চৌধুরী’। লক্ষ্মীকান্তর পিতা গঙ্গোপাধ্যায়ই ছিলেন। জীয়া গঙ্গোপাধ্যায়। হালিশহর থেকে আসছিলেন কালীঘাট। সঙ্গে সন্তানঅভিলাষী পরিবার। পদ্মাবতী। আর কুলদেবী। ভুবনেশ্বরী। কালীকুণ্ড চোখে পড়লো। বিশ্রাম নিতে চাইলেন। একটু মুখ-হাত ধুতে গেলেন। পত্নী স্নানে গেলেন। দৈববানী শোনা গেল। গর্ভে আসছে ঈশ্বর নির্দিষ্ট সন্তান। আরও শোনা গেল। ওই কুণ্ডেই আছে সতীর নিমজ্জিত দেহাংশ। দেখা দিলেন আত্মারাম ঠাকুর। উদ্ধার হল সতীর দেহাংশ। স্নানযাত্রায় প্রাণপ্রতিষ্ঠা হল। আর কোজাগরীতে এলো কূলতিলক। গৌড়বাণ সন্তান। ছুটে এসে দেখলেন জীয়া। পদ্মাবতী দেখতে পেলেন না। ইহলোক ত্যাগ করলেন। লক্ষ্মীপুজোর প্রাপ্তিতে নাম হল লক্ষ্মীকান্ত।
পত্নিবিয়োগে সংসারবিমুখ জীয়া। চলে গেলেন মণিকর্ণিকা। নিলেন সন্ন্যাস। হলেন কামদেব ব্রক্ষ্মচারী। অগুন্তি গুণমুগ্ধ হল। শিষ্য হল। মানসিংহ গুরু পেলেন। আর লক্ষ্মীকান্ত বাড়তে লাগলো অনেক দূরে। আত্মারাম ঠাকুরের কাছে। মানসিংহের সব মনে পড়ছে। গুরুদেব বলেছেন সব। কাশীতেই। গুরুদক্ষিণা স্বরূপ চেয়েছেন কিছু জমি। পুত্রের জন্য। লক্ষ্মীকান্তর জন্য। এখন সেই সময়। সম্রাট ক্ষমতা দিয়েছেন আগেই। মানসিংহ দিলেন নিষ্কর জায়গীর। সব মিলিয়ে আট পরগনা। অনেক পরিচিত গ্রাম। সুতানটি, কলিকাতা, গোবিন্দপুর, সালকিয়া, চিতপুর, কালীঘাট, বেতোর। ডায়মন্ড হারবার থেকে হালিশহর। জমিদারি পেল লক্ষ্মীকান্ত। প্রতিষ্ঠা পেল সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার।