হাওড়ার রুশদাহ হুমাইরা : বাংলার প্রথম ও একমাত্র Bean-To-Bar চকোলেট নির্মাতা
রুশদাহ হুমাইরা
চকোলেট বলতেই বেলজিয়াম, ঘানা, আইভরি কোস্টের, ইন্দোনেশিয়া কথা মনে পড়ে, কিন্তু পৃথিবীর অন্যতম উৎকৃষ্ট মানের কোকোয়া বা Cacao (যা থেকে চকোলেট উৎপাদিত হয়) পাওয়া যায় ভারতেই। চকোলেট নিয়ে মানুষের মধ্যে প্রচলিত ধারণাকেই ভাঙতে চাইছেন রুশদাহ হুমাইরা (Rushdah Humaira)। তিনি গড়ে তুলেছেন তাঁর নিজস্ব চকোলেট ব্র্যান্ড, রাশক্ (Rushk)। রুশদাহই প্রথম এবং একমাত্র বাঙালি, যিনি বিন-টু-বার (Bean-To-Bar) চকোলেট তৈরি করেন। রুশদাহই বলছিলেন, “মানুষ জানে না, পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ কোকো উৎপাদক দেশ হলো ভারত।”
চকোলেট তৈরি প্রক্রিয়া : কোকো রোস্টিং
ভারতে, ১৯৭৯ সালে কেরালা এগ্রিকালচারাল ইউনিভার্সিটিতে কোকো গবেষণা শুরু হয়। বর্তমানে, কেরালা, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ এবং তামিলনাড়ুতে কোকো চাষ হয়। রুশদাহ জানাচ্ছিলেন কীভাবে তিনি এসে পড়লেন চকোলেট তৈরির ব্যবসায়। রুশদাহ কাজ আরম্ভ করেছিলেন ২০২০ সালে, কিন্তু লকডাউনজনিত নানান সমস্যার কারণে সে’সময় দানা বাঁধতে পারেনি তাঁর ব্যবসা। ফের পুরোদমে কাজ শুরু করেছেন চলতি বছর অর্থাৎ ২০২৪ থেকে। কথায় বলে, ‘Necessity is the mother of invention’, রুশদাহর সঙ্গে কথা বলে মনে হল, চাহিদা ও ভালোবাসা থেকেই তাঁর এ কাজে এসে পড়া। পড়াশোনা করেছেন হোটেল ম্যানেজমেন্ট নিয়ে, ফুড ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বলছিলেন, “আমি বেকারিতে ছিলাম। তখন চকোলেট ব্যবহার করতাম অন্য কোম্পানির। ভারতীয় ব্র্যান্ড খুঁজেছিলাম। রিসার্চ করে দেখলাম ফার্ম থেকে ডিরেক্ট এনে চকোলেট কেউ বানাচ্ছেন না। কলকাতা, পশ্চিমবঙ্গ বা ভারতে... কাউকে পাইনি আমি। দু-একটা ভারতীয় কোম্পানি ছিল, কিন্তু তাদের চকোলেট দেখলাম অনেক দামি। ভাবলাম, এত দাম কেন! সব ভেবে শেষপর্যন্ত নিজেই রিসার্চ শুরু করি। সেই রিসার্চের ওপর ভিত্তি করেই নিজের চকোলেট ব্র্যান্ড তৈরি করা।”
ভারতে চকোলেট বলতে যে’সব ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে, বলা ভালো আমজনতা যেগুলোকে চকোলেট হিসেবে চিহ্নিত করে, সেগুলোতে চকোলেট থাকে নামমাত্র। সত্যি বলতে এখনও ভারতীয়দের মধ্যে চকোলেট নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সেদিক দিয়ে দেখলে, রুশদাহকে একজন চকোলেট-সচেতনতামূলক কর্মী বা Chocolate Activist বলা যায়।
বিন-টু-বার চকোলেট কীভাবে বানানো হয়, সে সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা দিলেন রুশদাহ। বললেন, “আমরা বিভিন্ন ফার্ম থেকে, কৃষকদের থেকে কোকো বিনস আনাই। তারপর একটা প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যাই। বিনসের বীজ থেকে চকোলেট বানাই আর হাস্ক অর্থাৎ খোসা থেকে কোকো টি (Cacao Tea) বানাই।” জানালেন, তাঁরা যে কোকো পাউডার, কোকো বিনস, কোকো বাটার ব্যবহার করেন, সব অর্গানিক, অ্যালকালাইজড নয়।
চকোলেট তৈরি প্রক্রিয়া : কোকো ক্র্যাকিং ও বিনোইং
অন্য কোনও দেশের নয়, রুশদাহ শুধুমাত্র ভারতীয় অরিজিনের, ভারতের কৃষকদের থেকেই কোকো বিনস সংগ্রহ করতে চান। তিনি চান ভারতের চকোলেট সারা বিশ্বে জনপ্রিয় হোক। বললেন, “কোকোয়া তো সব জায়গায় চাষ করা যায় না, দক্ষিণ ভারতে বেশি হয়। একমাত্র নির্দিষ্ট আবহাওয়ায়, নির্দিষ্ট ভৌগোলিক পরিবেশে এটা চাষ করা সম্ভব।”
আরও বললেন, “অনেকেই জানেন না চকোলেটের গাছ (Cacao Tree) আছে এবং সেই গাছের ফল থেকে কীভাবে বানানো হয় চকোলেট। কোকো ফল একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় শুকোতে হয়। যখন পুরোপুরি শুকিয়ে যায়, তারপর চকোলেট নির্মাতাদের কাছে পাঠানো হয়। আমরা কোকো বিনগুলোকে রোস্ট করি। কোকো ফলের একটা শক্ত খোসা থাকে। ভিতরে থাকে বীজ। রোস্টিং করে ক্র্যাকিং করার উদ্দেশ্য, খোসাটাকে বীজ থেকে ভালো ভাবে আলাদা করা। মানে এমন ভাবে ভাঙতে হবে, যাতে খোসা আর বীজ আলাদা আলাদা ভেঙে পড়ে। এটাকে বলে বিনোইং। ভ্যাকুয়ামে চলা একটা মেশিনের মাধ্যমে এটা করা হয়। তারপর সেই বীজগুলোকে গ্রাইন্ডিং করি, তিনদিন... চারদিন। চকোলেট বানাতে কমপক্ষে ৭২ ঘন্টা লাগে।”
চকোলেট তৈরি প্রক্রিয়া : কোকো রিফাইনিং
গোটা ম্যানুফ্যাকচারিং ইউনিট রয়েছে রুশদাহর ফ্যাক্টরিতে। সাঁতরাগাছিতে বাড়ির নীচেই তাঁর চকোলেট তৈরির কারখানা। সেখানেই চলে যাবতীয় কর্মযজ্ঞ। রুশদাহ বলছিলেন, চকোলেটের ব্যাবসায় আসার ক্ষেত্রে তিনি নিজেই নিজের অনুপ্রেরণা। শ্বশুরবাড়ির সাহায্য পান। বললেন, “ওঁরা পাশে আছেন বলেই কাজটা করতে পারছি।”
রুশদাহর ব্র্যান্ড রাশক্-এর ব্যবসা পুরোটাই অনলাইন মাধ্যমে চলে। রাশক্-এ পাওয়া যায়, নর্মাল চকোলেট, ফ্লেভারড চকোলেট, কোকো টি। ভারতে তাঁরাই একমাত্র কোকো টি বানান। জানাচ্ছিলেন, “কোকো টি-কে ‘চকোলেট টি’ (Chocolate Tea) বলা হয়। এটা ভারতে কেউ বানায় না। একদম অর্গানিক, কোকোয়া হাস্ক অর্থাৎ কোকো বিনের খোসা থেকে তৈরি হয়। অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট টি। গ্রিন টি-র মতোই খুব স্বাস্থ্যকর। এছাড়া কোকো পাউডার রাখি। আমরা বেকার্সদের জন্য কাস্টম চকোলেট বানাই।”
চকোলেট তৈরি প্রক্রিয়া : কোকো টেম্পারিং, এর পরই ইচ্ছেমতো গড়নে চকোলেট বানিয়ে নেওয়া যায়
কিছু কিছু ক্যাফের সঙ্গে যৌথ ভাবে ব্যবসা করতে চান তিনি, জানালেন আগামী পরিকল্পনার কথা। তাঁর কথায়, “শুধু একটা প্রোডাক্টের জন্য এখনই ক্যাফে খোলাটা আমার মনে হয় না বুদ্ধিমানের কাজ হবে! কিন্তু পরবর্তীকালে পরিকল্পনা আছে একটা ক্যাফে খুলবো, যেখানে চকোলেট এবং চকোলেট বেসড প্রোডাক্ট থাকবে।”
তীব্র তাপপ্রবাহ চলার কারণে, এখন কোকোর দাম খুব বেশি। তিনশো-চারশো টাকায় যে কোকো বিনস পাওয়া যেত, এখন তার দাম দু’হাজার থেকে চার হাজার টাকা। সেকারণেই এখন যতটুকু দরকার ততটুকুই চকোলেট বানাচ্ছেন রুশদাহ। যে কাস্টমাররা খাবারে রাশক্-এর চকোলেট ব্যবহার করেন শুধু তাঁদের জন্য। কারণ হিসাবে বলছেন, জলবায়ুর পরিবর্তন কোকো উৎপাদনে প্রভাব ফেলেছে। তাঁর নিজের কথায়, “এক কিলোর একটা ব্যাচ আগে ৮০০-৯০০ টাকায় বানাতাম, এখন সেটা তিন হাজার, চার হাজার টাকা লেগে যাচ্ছে। গ্রাহক বা ক্রেতাদের জন্য এটা একেবারেই সাশ্রয়ী নয়। জলবায়ু পরিবর্তন অনেক ধরনের চাষবাষেই প্রভাব ফেলেছে। বৃষ্টি পায়নি, প্রয়োজনীয় তাপমাত্রা পায়নি, বিনস খারাপ হয়েছে।”
তরুণ ফুড-এন্টারপ্রেনিওর বা খাদ্য-উদ্যোক্তা হিসেবে দ্য বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি’র (BCCI) তরফে স্বীকৃতিও পেয়েছেন
ভারতে চকোলেট বলতে যে’সব ব্র্যান্ডের নাম উঠে আসে, বলা ভালো আমজনতা যেগুলোকে চকোলেট হিসেবে চিহ্নিত করে, সেগুলোতে চকোলেট থাকে নামমাত্র, তাও বেশিরভাগই অন্য দেশের কোকো ব্যবহার করে। দেশের সম্পদের সঠিক ব্যবহার হচ্ছে কই! অনেক ক্ষেত্রে চকোলেটের এসেন্স দিয়েই কাজ চালায় অনেক ব্র্যান্ড। তাই খাঁটি চকোলেট আমাদের জন্য ‘সোনার পাথর বাটি’। সত্যি বলতে এখনও ভারতীয়দের মধ্যে চকোলেট নিয়ে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সেদিক দিয়ে দেখলে, রুশদাহকে একজন চকোলেট-সচেতনতামূলক কর্মী বা Chocolate Activist বলা যায়। তাঁর ক্রাফট চকোলেটের এই ব্যবসা কার্যত ‘চকোলেট আন্দোলন’ হয়ে উঠছে, যা মানুষের অজ্ঞতা দূর করবে এবং মানুষকে স্বাস্থ্যকর, অর্গানিক চকোলেটকে চিনে নিতে সাহায্য করবে।
rushkchocolates.com -এ দেখে নিতে পারেন রুশদাহ'র যাবতীয় কর্মকাণ্ড
____________
ছবি ঋণ:
রুশদাহ হুমাইরা