গ্রামীণ বাংলার হেঁশেলে ঐতিহাসিক জাউভাত

বাঙালির রান্নাঘর বলতে শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গ কিংবা বাংলাদেশের রান্না বোঝায় না। বঙ্গোপসাগরের উপর গঙ্গা এবং ব্রহ্মপুত্র নদী বৃহৎ ব-দ্বীপ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের রান্নাকেও কিন্তু বোঝায়। ‘বঙ্গ’ শব্দটির অর্থ সূর্যদেব। ১৪০০ শতাব্দীতে মুসলিম শাসন শুরুর হলে বঙ্গ পরিবর্তিত হয়ে যায় বাংলায়। এই বাংলায় বিভিন্ন সময় নানা-জাতি-ধর্মের মানুষ এসেছে। এদের প্রভাবও পরেছে বাংলার সমাজে সংস্কৃতিতে, সেই সঙ্গে খাদ্যাভ্যাসেও। কিন্তু একান্ত বাংলার খাবার সম্পর্কে জানতে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে প্রাচীন সাহিত্যের পাতায়। ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’-এ বাঙালির খাবারের এক অপূর্ব বর্ণনা পাওয়া যায়। সেখানে নাম না-জানা এক কবি লিখেছেন-
“ওগগরভত্তা রম্ভঅপত্তা, গাইকঘিত্তা দুগ্ধসজুত্তা।
মাইনি মচ্ছা নালিচ[ত] গচ্ছা দিজ্জই কন্ত খা গুণবন্তা।”
অর্থাৎ কলার পাতায় ঢালা ফ্যান সহযোগে গরম ভাত, সামান্য গাওয়া ঘি, গরম দুধ, ময়না বা ময়নি (মৌলি বা ময়লি মাছ) মাছ, নালিতা শাক (পাট শাক) কান্তা স্ত্রী পরিবেশন করছেন এবং পুণ্যবান খাচ্ছেন। ‘প্রাকৃতপৈঙ্গল’ অনুযায়ী ফ্যান ঢালা ভাত বলতে হয়তো জাউভাতকে বোঝানো হয়েছে। কারণ জাউ ভাত রান্না করার সময়ও ফ্যান ফেলা হয় না। এবং এই ভাত খেতে হয় ঘি দিয়ে।
আবার ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে ঈশ্বরী পাটনির আকাঙ্খা ছিল- ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে।’ জাউভাত দেখতে সাদা দুধে ভেজানো ভাতের মতো। এই ভাত সহজপাচ্য এবং এতে থাকে প্রোটিন, ভিটামিন-বি কমপ্লেক্স, ভিটামিন-ই, ক্যালোরিসমৃদ্ধ , অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর মত নানাধরনের উপকারী উপাদান। তাই হয়তো ঈশ্বরী পাটনি সন্তানের সুস্বাস্থ্যের জন্য অন্নপূর্ণার কাছে এই আবেদন করেছে। যাই হোক মতপার্থক্যে না গিয়ে আসুন শুরু করা যাক বাংলার রান্নাঘর।
জাউভাত নতুন আতপ চাল দিয়ে রান্না করা হয়। গ্রামবাংলায় কার্তিক পুজোর পরের দিন জাউভাত খাবার প্রচলন আছে এখনও। শীতকালের একটি লোভনীয় খাবার।
জাউভাত রান্না করা হয় নতুন আতপ চাল দিয়ে
কীভাবে রান্না করবেন –
রান্না করার সময় জল কম দিতে হবে। আতপ চালকে জলেই খুব ভালো করে সেদ্ধ করতে হবে। সেদ্ধ করার সময় একটু নুন দেবেন। অনেকে আবার সৈন্ধক লবণ দিয়েও খেয়ে থাকেন। রান্না করার সময় হাতা দিয়ে নাড়তে হবে যাতে পোড়া লেগে না যায়। এখানে ভাতের মাড় ফেলা হবে না। ভাত খুব ভালো করে সেদ্ধ হয়ে গেলে ঘি ছড়িয়ে নামিয়ে নিন। যাঁরা ঘি খেতে পারেন না তাঁরা বাটাও দিয়েও খেতে পারেন। সেক্ষেত্রে খাবারের সময়ই বাটা গরম জাউ ভাতে দিয়ে খান। জাউ ভাত খেতে হবে গরম গরম। গ্রামীণ ভাষায় ধোঁয়া উঠতে উঠতে খেতে হবে তাতে একটু জিভ পুড়লেও ক্ষতি নেই। শীতকালে পিঠে রোদ লাগাতে লাগাতে খান জাউ ভাত, সঙ্গে ছড়িয়ে নিন গাওয়া ঘি।
সঙ্গে কী নেবেন –
সাইড ডিশ কী হবে? কাঁচা তেঁতুল বাটা, গোলমরিচ অথবা কালোজিরে আধকাচরা বাটা, পাটপাতার বড়া। ফুলকপির বড়া, বেগুন ভাজা। সর্দি-কাশি অথবা গা ম্যাজম্যাজ করলে কালোজিরে বাটা দিয়ে এই জাউ ভাত খুব উপকারী হয়। আবার শীতের শুষ্কতায় গাওয়া ঘি শরীরে পক্ষে ভালো। আবার অনেকে এতে শীতে নানা সবজি দিয়ে এবং মটর ডাল একসঙ্গে সেদ্ধ করে খেতে পারেন। এর সঙ্গে রাখবেন মুলো, মটর-কুমড়ো বড়ি, তেল নুন কাচা লঙ্কা দিয়ে মাখা। যাঁরা মিষ্টি খাবেন তাঁরা পাকা কলা অথবা নারকেল কুড়ো দিয়েও মেখে খেতে পারেন। আতপ চালের বদলে ক্ষুদ দিয়েও খেতে পারেন। ক্ষুদের জাউ ভাতের সঙ্গে খান শুকনো লঙ্কা পুড়িয়ে কালোজিরে আধকাচড়া বেটে অল্প তেলে নুন দিয়ে ভেজে নিন। তারপর গরম গরম ভাতে খান। জমে যাবে পুরো।