ভাষা আন্দোলনের পোষ্টার

ধীরে ধীরে দানা বাঁধ ছিলো তীব্র অসন্তোষ। আর সেখান থেকেই গড়ে উঠছিল একটা আন্দোলন যার কেন্দ্রে ছিল ভাষা। বাঙালির মুখের ভাষা, লেখার ভাষা, প্রাণের ভাষা সেদিন মুক্তির নেশায় ছটফট করছিল কণ্ঠরোধের আওতা থেকে। মানচিত্রে তখন পূর্ব-পাকিস্তান মানে আজকের স্বাধীন দেশ, রাষ্ট্র বাংলাদেশের সম্পূর্ণ এক অন্য রাজনৈতিক অবস্থা। লক্ষ লক্ষ মানুষের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে জাতীয় ভাষা হিসেবে উর্দুর বয়ান। উর্দু ভাষার প্রতি মানুষের ভালোবাসা, সম্ভ্রম শ্রদ্ধা কোনওটাই কম ছিল না পূর্ব-পাকিস্তানে। কিন্তু নিজের প্রাণাধিক প্রিয় বাংলা ভাষাকে তাঁরা হৃদয় থেকে মুছে দেওয়ার প্রয়াসের নিন্দা শুরু করলেন। অফিস কাছাড়িতে বাংলা ভাষা বন্ধ করে দেওয়া হল। শিক্ষালয়ে বন্ধ করা হল বাংলা ভাষায় শিক্ষাচর্চা, সর্বোপরি প্রতি পদে পদে বাংলা ভাষাকে অবমাননার শিকার হতে হল। পূর্ব-পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ বাঙালি ফেটে পড়লো ক্ষোভে।
১৯৫২-র ২১ শে ফেব্রুয়ারি। লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল নামলো ঢাকার রাস্তায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে প্রতিবাদী ছাত্রদের ভিড়। এরই মধ্যে শুরু হয়ে গেল পুলিশের গুলি বৃষ্টি। গোটা পৃথিবী সেদিন স্তম্ভিত। বাংলা ভাষাকে বুকে আগলে সেদিন শহীদ হল বাঙালি। সেদিনের শহীদের রক্তেই দানা বাঁধলে মুক্তি যুদ্ধের অঙ্গীকার। ৭১ যার সর্বোচ্চ পর্যায়। এই ৭১ এর যুদ্ধের সময় শিল্পী সোমনাথ হোড় আঁকলেন একটি পোষ্টার। তখন গোটা পূর্ব-পাকিস্তান জুড়ে এক অদ্ভুত অবস্থা। একদিকে বাংলা ভাষার কণ্ঠ রোধ আর অন্যদিকে স্বাধীনতার নতুন স্বপ্ন। এরই মাঝে পোষ্টারটি তৈরি করলেন সোমনাথ হোড়। দেখা গেল দু’টি পাকিস্তানি চাঁদ-তারার সাড়াশি দিয়ে এক যুবকের কণ্ঠ রোধ করছে। চারিদিক লালরঙে রাঙিয়ে দিলেন শিল্পী কিন্তু এক বলিষ্ঠ যুবকের যুদ্ধকে অনুভব করতে বিন্দু মাত্র কষ্ট হয় না ছবিতে। শিল্পী এই ছবির নিচে দক্ষ ভাবে ব্যবহার করলেন কাজী নজরুল ইসলামের বল বীর কবিতার অংশ। ফলে ছবিটি এক অন্যমাত্রা পেয়ে গেল।
সাধারণ ভাবে যে সোমনাথ হোড়কে আমরা চিনি এই ছবি তার থেকে চরিত্রে একবারেই আলাদা। একদিকে মার্কসবাদী চেতনার পোষ্টার আঁকার রীতি আর অন্যদিকে একটি রাজনৈতিক ঘটনার প্রতি নিজের আত্ম প্রতিক্রিয়া এই প্রতিক্রিয়াই একটি ছবিকে ভিন্ন মাত্রা দেয়। বোঝা যায় একজন সংবেদনশীল শিল্পী কেবলমাত্র নিজ দেশের রাজনৈতিক ভাবনার প্রতি সচেতনশীল নয়। পাশা-পাশি বিশ্ব পরিস্থিতির উপরেও তাঁর নজর রয়েছে। এবং বাংলা ভাষার জন্য তাঁর এমন পোষ্টার ভারবর্ষের আর কোনও শিল্পী করেছেন বলে জানা নেই।