No Image

   

00:00
00:00
Volume

 0 Songs

    রসে বশে বাঙালি

    রসে বশে বাঙালি

    Story image

    বাঙালির রসবোধ হৃদয়হীনভাবে বিরল-হ্যাঁ, এরকম একটা কথা-ই জীবনানন্দ বলেছিলেন, তাঁর কোন একটা প্রবন্ধে সে আজ আর মনে নেই। আমার তো মনে  হয়, বাঙালির উইট সুইটার দ্যান সুইট। জীবনানন্দ আমার কাছে মহাপ্রাণ।তবুও তাঁর সাথে এ ব্যাপারে ঝগড়া করতে ইচ্ছে করে, বলতে ইচ্ছে করে, না দাশ মশাই আপনি ভুল, সব ঝুট হ্যায়। এ দারুণ দহন বেলায়, রস আছে। বাঙালির জীবনে রিউমারের তুলনায় হিউমারের প্রাবল্য।এমন কিছু মানুষের গল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অতলে ডুবে আছে, সেগুলো কুড়িয়ে এনে একটা জায়গায় করার জন্যেই বর্তমান লেখার অবতারণা। একটি নামী দামী রঙ কোম্পানির জন্য প্রচারভিত্তিক নাটক করতাম বি এ ক্লাসে পড়তে পড়তে।পশ্চিমবঙ্গের অনেক গ্রামে গিয়ে বলতে হত দিনমজুরদের, কেন তারা এই রঙ ব্যবহার করবে বাড়ির দেয়ালে।সেখানে সেই রঙ কোম্পানির তরফ থেকে আমাদের মিষ্টির প্যাকেট দেয়া হত, দেয়া হত উপস্থিত সমস্ত রঙ –মহলের কর্মীদের। তাদের নাম লিখে,ঠিকানা লিখে তারা মিষ্টির প্যাকেট পেত। একদিন এক রঙ কর্মী, নিজের নাম ঠিকানা লেখার পর আমাদের দিকে তাকিয়ে বলল, কই নাম ঠিকানাতো লিখলাম, গোত্র লিখব না। সেদিন থেকে ঘটনা মনে আছে, মানুষটাকে মনে নেই। পাশ দিয়ে গেলেও চিনতে পারব না। কিন্তু ঘটনাটা!

    এক বিখ্যাত দাদু তাঁর নাতিকে বলেছিলেন, বি এ ক্লাসে ভালো রেজাল্ট করলে বিলেতে যাবার খরচ দেবেন, নাতি তাই-ই করলেন,দাদুকে সে কথা মনে করালে, দাদু বললেন, অর্ধেক খরচ দিচ্ছি, বাকিটা বিয়ে করে পণ নিয়ে জোগাড় করো।নাতিটি বলেছিলেন, দাদু, পুরুষাঙ্গ বাঁধা দিয়ে বিলেত যাবো না।” দাদু ছিলেন দীনেশচন্দ্র সেন, নাতিটি ছিলেন কবি সমর সেন।

    আরো একটা ঘটনা না উল্লেখ করে পারছি না, অন্নদাশঙ্কর রায় তখন অবসর নিয়ে শান্তিনিকেতনে থাকেন, সঙ্গে বিদেশিনী স্ত্রী লীলা রায়। যিনি পারতপক্ষে বাংলা ছাড়া অন্য ভাষায় কথা বলতেন না, চেষ্টা করতেন খাঁটি বাঙালি হবার। সৈয়দ মুজতবা আলি গেছেন ওঁদের বাড়িতে।গিয়ে দেখেন বাগান পরিষ্কার করছেন লীলা রায়, অন্নদাশঙ্করের কথা জিজ্ঞেস করাতে লীলা বললেন, উনি সৃষ্টি কর্মে ব্যাপৃত আছেন। মুজতবা আলির মন্তব্য, তাহলে আপনি এখানে বাইরে কী করছেন, মিসেস রায়।

    সত্যিই রসবোধ ইদানিং আর দেখা যায় না। জীবনানন্দের কথা মেনে নিতেই হয়। সুকুমার রায়ের কাছে তাঁর মা, কেমন পাত্রী পছন্দ জানতে চাইলে সুকুমার বলেন, সুন্দর ফুন্দর বুঝিনা, দেখতে খারাপ না হলেই হল, আর ইয়ার্কি মারলে যেন বুঝিয়ে না বলতে হয়। এরকম উত্তর দেবার লোক সত্যিই আর চোখে পড়ে না। চারিদিকে প্রচন্ড সিরিয়াস আর প্রচন্ড অগভীর লোকের ভিড়ে এরকম লোক কোথাও আর পাইনা। ইয়ার্কি বলতে এখন যৌন উত্তেজনামুলক ফাজলামো।

    বাতায়ন পত্রিকার অবিনাশ ঘোষাল ছিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রিয়পাত্র, দুজনের মধ্যে অগ্রজ- অনুজের সম্পর্ক ছিল। একদিন শরৎচন্দ্রের ভেলি নামের প্রিয় কুকুর মারা গেলে, শরৎ ভেঙ্গে পড়ায়, শিবরাম তাঁকে ছোট্ট একটি চিঠিতে লেখেন, ভেলির বিনাশ নাই, / ভেলি ‘ অবিনাশ’।শিবরাম চক্রবর্তী আমার কাছে একটা জংশনের মত। আমি থামি সেখানে অনেকক্ষণ। দাঁড়াই, চা খাই, আনাজওয়ালাকে জিগ্যেস করি, পটল কত করে। শিবরামের আর একটা লেখা আমার মাথায় আসছে। ১৩৫৫ বঙ্গাব্দে ‘চিত্রকলা’ শিরোনামে একটা লেখায় লিখছেন, ‘গান হচ্ছে কুরুক্ষেত্র ব্যাপার, একটিই হোক বা একাধিকই হোক, কর্ণবধেই তার সার্থকতা।’ ভেবে দেখবার মত শব্দবন্ধ ব্যবহার করেছিলেন জীবনানন্দ, ‘হৃদয়হীনভাবে বিরল’-এই বিরলতা রুথলেশ, কিংবা রুটলেস বাঙালির জন্য এটাই নিয়তি।

    ১৮৭৮ সালের বঙ্গদর্শন- পত্রিকায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী ‘তৈল’ শীর্ষক রচনায় যা লিখছেন তার প্রথম কটা বাক্য তুলে ধরছি, ‘তৈল যে কী পদার্থ, তাহা সংস্কৃত কবিরা কতক বুঝিয়াছিলেন। তাঁহাদের মতে তৈলের অপর নাম স্নেহ-বাস্তবিক স্নেহ ও তৈল একই পদার্থ।আমি তোমায় স্নেহ করি, তুমি আমায় স্নেহ কর, অর্থাৎ আমরা পরস্পরকে তৈল দিয়া থাকি।’

    যে সময় এ লেখাটা লিখছি তখন আবির সিং খাঙ্গুরার একটা বেহাগ চলছে, এই আসরে ইমন নয়, ললিত নিয়ে একটা ঘটনার কথা মনে পড়ছে। এক ভদ্রলোক শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের আসরে গেছেন, তাঁর দৌড় ললিত অবধি। ললিত রাগটুকুর নাম তিনি জানেন। পাশে বসা লোকটিকে বললেন, এটা কী রাগ ললিত, ভদ্রলোক বললেন, এ তো ইমন, এখন সন্ধ্যেবেলা না। সন্ধ্যে পেরিয়ে রাত, আর একজন শুরু করলেন দরবারী। আবার জিজ্ঞাসুর এক জিজ্ঞাসা। ভদ্রলোক বললেন, এটা তো দরবারী। ললিত সকালের রাগ, এখনতো রাত। ভদ্রলোক নিরাশায় আপাতত কাৎ। সকাল হতেই আর একটি রাগ, এবার নিশ্চয়ই ললিত। ভদ্রলোক ক্ষেপে গিয়ে বললেন, না এ ললিতের ভাই অসিত, কর্পোরেশনে চাকরি করে। অসিতের জায়গায় নিশীথ হতে পারে। কিন্তু গল্পটা এই-ই। কুমারপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের বইতে আছে।

    আর একজনের রসবোধের কথা বলে বোধহয় শেষ করা উচিত।তাঁকে তাঁর বাবা গলায় উপবীত দিয়ে বলেছিলেন, জীবনে কারো কাছে হাত না পাততে। তিনি ঈশ্বরের কাছেও পাতেননি। তাঁর স্ত্রী ছেলের আরোগ্য কামনায় দেবী দুর্গার পুজো দিলে, তিনি বললেন, যে নিজের ছেলের হাতির মত শুঁড় ভালো করে দিতে পারেনা, সে তোমার ছেলের অসুখ ভালো করে দেবে।সত্যিই তো বিদূষক শরৎচন্দ্র পন্ডিতের মত লোক হৃদয়হীন,ভাবে ও বিরল।

    বঙ্গদর্শনের সপ্তাহের বাছাই করা ফিচার আপনার ইনবক্সে পেতে

    @