৫০ বছরে ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো আর গপ্পো : গৃহহীন জাতিস্মর

যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪)
- “কারণ আমি চোখের ’পরে দুঃখের কটাক্ষ তো দেখছি”
- “আমার ইউনিভার্সাল গালাগালি”
- “কিন্তু চারপাশে আমি রিয়েলিটি দেখেছি তো?”
- “আমার কোনো থিওরি নেই”
মদন তাঁতির গল্পটা বুঝে উঠতে আমাদের বড্ড দেরি হয়ে যায়। একটা ফাঁকা তাঁতের মতন সমাজব্যবস্থার সামনে বসে একটা সিনেমা আমরা চালিয়ে রেখেছি গত পঞ্চাশটা বছর।
যুক্তি
তক্কো আর গপ্পো
ক্ষুধার্ত এক সিনেমা, যা কিছু দৃশ্য দেখাতে চেয়েছিল। কোনো স্লোগান নয়, কোনো অভিমত নয়, পারিপার্শ্ব পেরিয়ে পারিপার্শ্বিক কিছু সত্যকে রেকর্ড করে রেখে দেওয়া। ঋত্বিক ঘটক তাঁর এক সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেছিলেন, “ছবিতে আমি স্লোগানে বিশ্বাস করি না। ওর থেকে যদি কিছু emerge করে, through situation, through conflict, যদি কিছু তোমাদের মাইন্ডে আসে তো এলো। কিন্তু আমি ‘এইটেই সলিউশন’ বলতে পারি না। …কিন্তু এইগুলোকে ধরা উচিত, কারণ আমি চোখের ‘পরে দুঃখের কটাক্ষ তো দেখছি।”
আমরা দেখছি, শুরুর দৃশ্য থেকে এক চাষি বসে আছে - সিনেমার শুরুতে বসে আছে এবং সিনেমার শেষেও বসে আছে। মাঝখানে ঘটে যাচ্ছে সমাজনৈতিক তামাশা, রাজনৈতিক দলবাজি, দাদাগিরি, বিভেদ অথবা সমন্বয়ের বুলি– ‘থ্রু সিচুয়েশন’ উঠে আসছে গপ্পো, ‘থ্রু কনফ্লিক্ট’ উঠে আসছে যুক্তি-তক্কো। বাকি সুতোটা আমাদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন পরিচালক। কিন্তু স্রষ্টা হয়েও সমাধান জানানোর মতন কোনো উঁচ্চতর অবস্থানে দাঁড়াচ্ছেন না তিনি। আমরা কয়েকজন দর্শক ওই মাটিতে একত্রে বসেই তাকিয়ে দেখবো একজন খুন হয়ে যাওয়া স্রষ্টার শেষ দেখার দিকে।
ঋত্বিকের শারীরিকক্ষয় ও মৃত্যু এবং ক্যামেরায় নীলকণ্ঠের মৃত্যুময়তার মাতলামির সামনে এভাবে না দাঁড়ালে আমরা হয়তো কখনোই ‘রেট্রোস্পেকটিভ ট্রমা’র ভেতর দিয়ে এতখানি ব্যক্তিগতভাবে এই অবক্ষয়কে দেখতে পারতাম না।
আত্মজীবনী নয়, ডায়েরি নয়, ‘ডক্যুমেন্টেশন’। এমন এক সৃষ্টি, যা মৃত্যুর মতোই ঋত্বিকের পূর্ববর্তী সব সৃষ্টিকে পূর্ণ-প্রকাশের পথ করে দিয়েছে। ঋত্বিকের শারীরিকক্ষয় ও মৃত্যু এবং ক্যামেরায় নীলকণ্ঠের মৃত্যুময়তার মাতলামির সামনে এভাবে না দাঁড়ালে আমরা হয়তো কখনোই ‘রেট্রোস্পেকটিভ ট্রমা’র ভেতর দিয়ে এতখানি ব্যক্তিগতভাবে এই অবক্ষয়কে দেখতে পারতাম না।
আত্মপরিচয় ও মন্তাজ
আমাদের সামনে সত্যিটা এইটুকুই যে, ‘কচুরিপানার মতো’ নচিকেতা আর বাংলাদেশের আত্মা ভেসে-ভেসে বেড়াবে আর নীলকণ্ঠর জীবনে আসতে থাকে আত্মপরিচয়ের একের পর সন্দেহ।
‘কী রকমের বুদ্ধিজীবী তুমি নীল?’ - ছবির একেবারে প্রথম দিক থেকেই নীলকণ্ঠের নিকটতম মানুষের মুখে যে প্রশ্ন শুরু হয়, সেই প্রশ্ন বিভিন্ন দৃশ্যে বিভিন্ন কারণে ফিরে আসবে গোটা ছবি জুড়ে। তার হাজারো উত্তরে আমরা শুনবো - ‘মাতাল’, ‘কোয়াইট ওয়েল-নোন ম্যান’, শুনবো ‘হি হ্যাজ নো পলিটিক্স’, শুনবো ‘ভাঙা বুদ্ধিজীবী’, ‘ব্রোকেন ইনটেলেকচুয়াল’, ‘ক্ষয়িষ্ণু প্রতিনিধি’ ইত্যাদি ইত্যাদি। দেখবো, নিজের কথায় এবং অন্যের মুখে-মুখে বারবার উঠে আসছে নীলকণ্ঠের আইডেন্টিটির প্রশ্নের উত্তর। আর মাঝখানে প্রত্যাশিতভাবে এসে পড়ছে বঙ্গবালার ঘুমপাড়ানি গান আর প্রশ্নহীন প্রশ্রয় – ‘এক্কেরে পোলাপান’।
শেষ পর্যন্ত সে এক জাতিস্মর, ছিন্নমূল জাতিস্মর… যে দেশে-দেশে কালে-কালে শিকড়চ্যূত। আমাদের দেশভাগ হোক, অথবা আজকের আমেরিকান মিড-ওয়েস্টের ট্রেলার জীবন, পূর্ব ইউরোপের কোল্ড ওয়ারের সময়কার একেকটি সামরিক কাঁটাতার হোক অথবা দশ বছর আগের তুরস্ক-সিরিয়ার এপারে-ওপারে ভাষা ও স্বজন আলাদা হয়ে যাওয়া সীমান্তের প্রহসন – এভাবে দেশ ও প্রদেশের নাম বলতে থাকলে দেখবো এই যন্ত্রণার এক্সটেনশনের কোনো শেষ নেই, ছিল না এবং শেষ পাওয়াও যাবে না। বরং ডিসপ্লেসমেন্টের দুঃখ দিয়ে যে ইতিহাস লেখা, আমরা বড়োজোর সেই ইতিহাসের ছোটো-ছোটো অংশকে নথিভুক্ত করতে পারি, প্রদর্শন করতে পারি, ম্যাগ্নিফাই করতে পারি।
ছৌ নাচের দৃশ্যগ্রহণ ও মন্তাজের ভেতর দিয়ে এই ছবিতে যেন গোটা-গোটা গল্প লিখে রেখেছেন ঋত্বিক। ছৌয়ের মুখোশ দেখে বঙ্গবালার প্রবল ইচ্ছাপ্রকাশ – ‘মুই লাচুম’। যে মুখোশ মেয়েদের পরার নিয়ম নেই অথচ যে মুখোশ নারীশক্তিতে রূপান্তরিত করে পুরুষকে, সেই মুখোশের ওপর অধিকার দখলের একটা ধাপ।
পরিত্যক্ত নীলকণ্ঠর মুখে ও শরীরে আলোর ওয়াশ-আউট, চরিত্রের মুখ ও প্রতিচ্ছবির সহাবস্থান, মুখের রেখার একেবারে কাছাকাছি এসে পড়া হাইপার রিয়ালিস্টিক ঘনিষ্ঠতা, ইনক্লিউসিভ আই লেভেল ক্যামেরা, অত্যন্ত যত্নশীল কয়েকটি লো অ্যাঙ্গেল এবং বারবার একাধিক দ্বৈত-চরিত্রের ক্লোজ-আপ – এ ছবির বিপুল ও বিস্তারিত শট-ডিভিশন নিয়ে মন্তব্যের অবকাশ এই প্রবন্ধে নেই। কেবল চোখের সামনে আখ্যানটুকু রেখে আন্তরিক বিশ্লেষণে ঋত্বিকের ওই ‘ইউনিভার্সাল গালাগালি’টা আমরা আঁচ করার চেষ্টা করতে পারি মাত্র। তবু আমরা খেয়াল রাখবো, তিনি একের পর এক দৃশ্য কীভাবে কনসেপচুয়ালি সাজিয়েছেন অথবা কীভাবে এলোমেলো করেছেন সিনেমা-জুড়ে আর সেই মন্তাজে সমকালকে দেখতে দেখতে কোথাও একটা আমরাও বুঝে নেবো যে যুক্তি-তক্কোগুলো রয়ে যাবে, দরকার মতো কেবল গপ্পের মোড়কগুলো বদলে দিতে হবে বছরে-দশকে-শতকে, ঋত্বিকের আগে ও পরে।
মুখোশ থেকে মুখ: জাম্পকাট থেকে ডিসলভ
সাধারণত চোখের সমানে আই-লেভেল ক্যামেরাকে বাস্তববাদী বলে ধরা হয়। রিয়েলিজমের অংশ হিসেবে প্রায় গোটা সিনেমার অনেক দৃশ্যেই আমরা তেমনই একজন বাড়তি মানুষের মতন ঢুকে পড়ছি। আবার পাশাপাশি লক্ষ্য করবো, হাইপার-রিয়েলিজমের এক অন্য দৃষ্টিকোণ ঋত্বিক আনছেন এই ছবিতে, ক্লোজ-আপ এবং কিছু লো-অ্যাঙ্গেল শটের ব্যবহারে। অনেকগুলো দৃশ্যেই ক্যামেরা পড়ে থাকছে প্রায় মেঝেতে এবং অনেকসময়ই এসে পড়ছে চরিত্রের মুখের খুব কাছে। শট ডিভিশনের মধ্যে দিয়েই একেকটি চরিত্রকে কখনও নিচু থেকে লার্জার দ্যান লাইফ, আর কখনও একেবারে কাছ থেকে দেখছি আমরা এবং বুঝতে চেষ্টা করছি কখন-কোথায়-কীভাবে চারিত্রিক মুখোশ খসে যায় অথবা আরো জরুরি, কীভাবে চরিত্রেরা মুখোশ পরে ফেলে অজান্তেই।
ছৌ নাচের দৃশ্যগ্রহণ ও মন্তাজের ভেতর দিয়ে এই ছবিতে যেন গোটা-গোটা গল্প লিখে রেখেছেন ঋত্বিক। ছৌয়ের মুখোশ দেখে বঙ্গবালার প্রবল ইচ্ছাপ্রকাশ – ‘মুই লাচুম’। যে মুখোশ মেয়েদের পরার নিয়ম নেই অথচ যে মুখোশ নারীশক্তিতে রূপান্তরিত করে পুরুষকে, সেই মুখোশের ওপর অধিকার দখলের একটা ধাপ। তারপর একটা হঠাৎ আলোর ঝলকানি -বঙ্গবালার মুখে জিতে যাওয়ার নিবিড় কনভিন্সিং ক্লোজ-আপ আর মুখোশ নির্মাতার মুখে হেরে যাওয়ার উজ্জ্বলতা। শুরুতেই হেরে যাচ্ছে বদ্ধ সংস্কার অর্থাৎ ঋত্বিক আমাদের এক প্রাচীন লোকশিল্পের কাছে নিয়েই যাচ্ছেন প্রাচীন সংস্কার ভাঙার পথ দিয়ে।
তারপর একটা লাফ, একটা আক্ষরিক জাম্প, এবং ছবি কাট করে চলে আসছে ছৌ নাচের শক্ত জমিতে। এখানে রবীন্দ্রনাথের একটি বিশেষ বক্তব্য মনে পড়ে – “ভাবুকের চিত্তের মধ্যে রঙ্গমঞ্চ আছে, সে রঙ্গমঞ্চে স্থানাভাব নাই। সেখানে যাদুকরের হাতে দৃশ্যপট আপনি রচিত হইতে থাকে। সেই মঞ্চ, সেই পটই নাট্যকারের লক্ষ্যস্থল, কোনো কৃত্রিম মঞ্চ ও কৃত্রিম পট কবিকল্পনার উপযুক্ত হইতে পারে না।” এই উক্তির অবতারণায় সেই প্রবন্ধেই রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, কাব্যের মহত্ত্ব যেন নাট্যমঞ্চের বা মঞ্চসজ্জার ক্ষুদ্রতায় আটকে না পড়ে। ছৌ নাচের দৃশ্যান্তরে ঋত্বিক আমাদের টেনে নিয়ে গেলেন সেই বৃহৎ মঞ্চে, যেখানে আমরা ঘরের উঠোন থেকে প্রবেশ করলাম (বঙ্গবালা-র সঙ্গে) এক লাফে এবং গিয়ে দেখলাম যে সেই মাটিতে আঞ্চলিক মানুষেরই অধিকার। নাচের সময় জুড়ে নিরন্তর দৃশ্য আসা-যাওয়া করতে থাকে ছৌয়ের আসরকে ঘিরে থাকা বাচ্চা-বুড়ো-নারী-পুরুষ আর নাচে অংশ নেওয়া গল্পের চরিত্রদের মধ্যে। নাচের দমকে দেবতারাও কখন যেন প্রায় ক্যামেরার ওপর এসে পড়ছে, ঠিক যেমনটি হওয়ার কথা সামনের সারিতে দাঁড়াতে বা বসতে গেলে। এরপর এক দীর্ঘ পালা চলে এবং ক্যামেরা এক মাপা উচ্চতায় ঘোরাফেরা করে। আমরা লক্ষ্য করবো, হয় তা প্রায় মাটির কাছে অথবা চোখ ও কাঁধসমান উচ্চতায়। এই সমগ্র দৃশ্যে আমরা মাটিতে বসা অথবা দাঁড়িয়ে থাকা ভিড়ের ভেতরেই থাকতে বাধ্য।
“আশৈশব শিক্ষায় আমরা স্বর্গমর্ত্ত্যকে মনে মনে ভাগ করিয়া রাখিয়াছি। সর্ব্বদাই সন্তর্পণে ছিলাম, পাছে দেব-আদর্শে মানব ভাবের কোনো আঁচ লাগে; পাছে দেবমানবের মধ্যে যে পরমপবিত্র সুদূর ব্যবধান, ক্ষুদ্রমানব তাহা লেশমাত্র লঙ্ঘন করে। এখানেমানুষ দেবতার একেবারে যেন গায়ের উপর আসিয়া পড়িয়াছে। তাও যে ধূলাঝাড়িয়া আসিয়াছে, তাও নয়। গতিশীল, কর্ম্মরত, ধূলিলিপ্ত সংসারের প্রতিকৃতি নিঃসঙ্কোচে সমুচ্চ হইয়া উঠিয়া দেবতার প্রতিমূর্ত্তিকে আচ্ছন্ন করিয়া রহিয়াছে।” - একটি বিশেষ মন্দিরের প্রাচীন কারুকার্যের প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সেই অনুষঙ্গকে ছাপিয়ে এই আশ্চর্য মন্তব্য লিখে রেখেছিলেন একটি প্রবন্ধে।
এই ভাবনার এক সরাসরি প্রতিফলন- ছৌ নাচের দানবদলন, পৌরাণিক মাতৃবন্দনা, গ্রাম জুড়ে মানুষের ছৌ-শিল্পের ভেতর প্রাত্যহিক জীবন, তার পশুত্ব, মনুষ্যত্ব এবং দেবত্ব – সমস্তটাই যেন সরাসরি ঋত্বিকের ক্যামেরায় ধরা পড়েছে।
মুখোশশিল্পী আর সংস্কৃত শিক্ষকের টানাপোড়েনে আরেকটু ফিরে যাই। বলা বাহুল্য, যে তর্কটা হচ্ছে, তা চিরকালীন এবং তা তাত্ত্বিকভাবে মেটার নয়। ভারতীয় সমাজে এই তর্ক কোনোদিনই মেটেওনি। আবার ছবিতে দেখানো তর্কটুকু মাতৃত্ব ঘিরে তৈরি হলেও, আসলে পৃথিবীর যেকোনো আলোকপ্রাপ্ত বিভাজিত সমাজ-সাপেক্ষেই এই দ্বন্দ্ব বোধহয় কখনোই মেটার নয়।
- যা বিদেশি, তাহাই ম্লেচ্ছ
- সংস্কৃত বিদেশি?
- এখানে সংস্কৃত কে বলে বটে?
শাস্ত্র-পুরাণ ও লোকায়তের এই নিরন্তর দ্বন্দ্বের মধ্যে দেখছি বঙ্গবালার শাসন, মায়ের শাসন। যেহেতু মা এখানে মাটি এবং মা সংস্কার-ভাঙার পথ, তাই এই তফাৎ মেটাতেও তারই এসে পড়া। এখানে মাকে মানা মানে শক্তিকেই মান্য করা। সেইসঙ্গে লালনপালনের আধারস্বরূপ ধরিত্রীকেও মান্য করা। আর সেই জন্যেই হয়তো ‘দংষ্ট্রা করালবদনী’র সংহারশক্তির উপাসনার পরেই যখন সেই ‘মা’ ভাত বেড়ে নিয়ে আসে, তা আমাদের আশ্চর্য লাগে না। আর এ-ও আশ্চর্য লাগে না যে, ক্ষুধার্ত ছেলেটির ভাত-ফেলে উঠে যাওয়ার মতন এক অতি-চেনা সাংসারিক ছবিতে এক আঘাতেই তাঁকে কেঁদে ফেলতে হয়।
তবু আমরা দেখলাম, কখন যেন একটা ঘরহারা (বাস্তুহারা, সর্বহারা এবং সমস্ত অবমানবায়নের শব্দগুলো বসিয়ে নিন) মেয়ে এক দেবত্বের মুখোশকে জড়িয়ে ধরছে বুকে আর মুখোশের আদরে আলোছায়ায় একটা নিভৃত আত্ম-চরিত তৈরি করছে নিজেই। মুখ থেকে মুখোশ থেকে মুখের দিকে বঙ্গবালার আত্মার ভেতর যে যাত্রাপথ, তা এক অপূর্ব ইমেজে ডিসল্ভ করে আসছে ঋত্বিকের ক্যামেরায়, আর আমরা ‘প্রিভিলেজড’ দর্শক সেই রূপান্তরের সাক্ষী হয়ে থাকছি নিরাপদ দূরত্বে।
শেষ পর্যন্ত “যাও দাওয়ায় গিয়া বও - এত দূরে দূরে ক্যান, এত ফারাক ক্যান?”– এই প্রশ্ন শুনে মনে পড়ে বঙ্গবালার এই রাগত স্বরের কথাটাই হয়তো এই চলচ্চিত্রের এক মূল জিজ্ঞাসা। এই লেখায় কোথাও এমন কোনো দাবি করবো না, যে ঋত্বিক এইটিকে মূল প্রশ্ন বলেছেন। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীর এক দর্শকের জায়গা থেকে, রাজনৈতিক দক্ষিণপন্থার হাওয়ার মধ্যে দাঁড়িয়ে এ এক একান্ত নিজস্ব মনে-হওয়া।
হিন্দুত্বের ভেতর বৌদ্ধধর্মের মিশ্রণের কথা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, “মানুষের ক্ষুদ্র কাজেকর্ম্মে শক্তির প্রত্যক্ষ হাত, মানুষের স্নেহপ্রীতির সম্বন্ধের মধ্যে দিব্যপ্রেমের প্রত্যক্ষ লীলা অত্যন্ত নিকটবর্ত্তী হইয়া দেখা দিল। এই দেবতার আবির্ভাবে ছোটো-বড়োর ভেদ ঘুচিবার চেষ্টা করিতে লাগিল। সমাজে যাহারা ঘৃণিত ছিল, তাহারাও দৈবশক্তির অধিকারী বলিয়া অভিমান করিল-প্রাকৃত পুরাণগুলিতে তাহার ইতিহাস রহিয়াছে।”
‘তিতাস’ তৈরি করার পরে এবং ‘যুক্তি তক্কো’র কাজের সময় ঋত্বিক একবার মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন এবং আবারও একটা অবধারিত মৃত্যুর সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। নিজের শারীরিক মৃত্যু।
নিঃস্বার্থ সংমিশ্রণের এই উদযাপন রবীন্দ্রনাথের ভাবনায় এতদূর ব্যাপৃত না হলে কীভাবেই বা তাঁরই লেখা ‘কেন চেয়ে আছো গো মা?’ গানটি এমনভাবে এই ছবিতে মিশে যায় আর কীভাবেই বা গানটি স্বদেশ পর্যায়ের অব্যক্তিগত রূপ থেকে সত্যিকারের একটা রক্তমাংসের প্রশ্ন হয়ে উঠতেপারে ঋত্বিকের হাতে?
আমাদেরকে যদি আবার সেই শাস্ত্র আর লোকায়তের দ্বন্দ্বের মধ্যেই গিয়ে দাঁড়াতে হয়, যদি সূক্ষ্ম সামাজিক বিভেদগুলো এভাবেই বয়ে বেড়াতে হয়, তাহলে একটা বৃহত্তর দায়েরও অংশীদার হতে হবে আমাদেরকেই। মানবসভ্যতা ও প্রকৃতি সাপেক্ষে এইসব তর্ক এত শিশুতোষ আর সেই তর্কই যে হাজার বছর ধরে আমাদের সমাজকে চালিত করেছে, তাও মেনে নিতে হয়। আর হঠাৎ অবাক হয়ে যেতে হয় ভাবলে, যে আমাদের সভ্যতার অধিকাংশ কন্সট্রাক্ট আসলে এইরকমই শিশুসুলভ। কাজেই সমাজের শ্রেণি-চিহ্নের মাথাগুলোকে “কাছে ঘইন্যা আসো! হাসো হাসো” বলে ঠুকে দেওয়া ছাড়া আর কোনো থামবার পথ আছে বলে আজও মনে হয় না।
গৃহহীন জাতিস্মর
হা-ক্লান্ত একটা দল, আপাত-উদবাস্তু একটা দল রাত্রিবেলা জুড়ে জঙ্গলে বসে আছে আর তাদের আশেপাশে ঘোরাফেরা করছে রাষ্ট্রীয় শাসনের বারুদ – এই ভাবনাটুকুই পর্দায় একশোটা প্রশ্ন নিয়ে আসতে সক্ষম। ইমেজ ও ইমেজারির জোর, যা গোটা গল্পটাকে প্রতিষ্ঠা করছে, বুকের মধ্যে যন্ত্রণার একটা ব্ল্যাকহোল নিয়ে না ঘুরলে এর ভেতরে প্রবেশপথ পাওয়া বড়ো কঠিন। আর একবার প্রবেশের পর কোনো নির্গমন বা এস্কেপ খোঁজাও বৃথা।
আমাদের হাতে একটা জৈবনিক ক্যামেরা এবং সামনে অনেকগুলো কাঁটাতার, ‘সারি সারি পাঁচিল’। আংশিক আলো পড়ে এক যুগলের মুখে এবং তাদের আশ্রয়-গাছে এবং পায়ের তলার মাটি অন্ধকার। একটা সংযোগ। তারপর জীবনের বীজ বোনার ধাপগুলোর দিকে এগোতে এগোতে এইখানে বেজে ওঠে সঙ্গম-শব্দের ওঠাপড়া। এসে পড়ে দুটো শটের মাঝখানে এক ‘মাতাল, নন-পলিটিকাল’ মুখের ক্লোজ-আপ – যেখানে খুব থেমে থেমে নীল লিখছেন একটা সুইসাইড নোট - ‘জীবন জীবিতের, জীবিতের ধর্ম’। নেশা এবং রক্তক্ষরণের আবরণের আড়ালে বসে এই জীবনমুখী আত্মহত্যার ভেতরে মনে পড়ে সন্দীপন ঋত্বিকের মতন শিল্পীর অস্থিরতা বিষয়ে লিখলেন, ‘প্যারানোয়িআ তাই সুস্থতার দিকে, নিজের দিকে যাত্রা’।
গৃহহীন জাতিস্মরের মতন আমরা মৃত্যু ঘিরেই গল্পটা শুরু ও শেষ করবো। জাতিস্মর মানেই আমরা তার পূর্ব জন্মের স্মৃতিগুলোর কথা জানি। জাতিস্মর মানেই আমরা জানি সে নিজের একটি মৃত্যু অন্তত পেরিয়ে এসেছে। আমাদের মনে পড়বে, ‘তিতাস’ তৈরি করার পরে এবং ‘যুক্তি তক্কো’র কাজের সময় ঋত্বিক একবার মৃতপ্রায় অবস্থা থেকে উঠে এসেছেন এবং আবারও একটা অবধারিত মৃত্যুর সামনেই দাঁড়িয়ে রয়েছেন। নিজের শারীরিক মৃত্যু। আর তাই এই ছবিতে প্রতি দৃশ্যে নিজের শরীরকে ব্যবহার করে বারবার রেখে যাচ্ছেন অবিরাম অ্যাডিকশনের মতন কনজিউমারিজম। দ্য বডি অফ দ্য অ্যাক্টর ইজ বিকামিং আ টুল টু মেক দ্যাট স্টেটমেন্ট। এবং তা মিলে যাচ্ছে ঋত্বিক ঘটকের ছবি তৈরির বিশ্বাসের সঙ্গে, যে অভিনেতারা আসলে “চলমান সবাক প্রপার্টিজ”। ক্রমাগত গলায় দেশজ মদ্য ঢালতে থাকার একটা নেশাগ্রস্ত ক্যাওস দেখাতে দেখাতে শেষ পর্যন্ত শুধু নিজের শরীরে নয়, আক্ষরিক অর্থেই তাঁর ক্যামেরার গায়েই ঢেলে দিচ্ছেন দেশের তরল নেশা। আর এই প্রথম ও শেষবার, আনপ্রিসিডেন্টেডভাবে – তাঁর ছবিতে ক্যামেরা হয়ে যাচ্ছে অভিনয়ের অংশ। বাস্তবের ওপর একটা আস্তরণ তৈরি হচ্ছে ব্যক্তিগত অতি-বাস্তবের। ডুবতে থাকা নীলকণ্ঠ ক্রমশ দূরে সরতে থাকা পরিবারকে বলতে পারছেন তাঁর পরবর্তী প্রজন্মকে ভোরের আলোয় একবার দেখে যাওয়ার কথা। একটা ফিউচার স্ন্যাপশট – যা তিনি সঙ্গে করে নিয়ে যাবেন বাকি পথ অথবা বাকি জন্মগুলো।
আমাদের এইসব প্রজন্ম-পেরোনো প্রার্থনার বীজগুলো কোথায় পুঁতে আসতে হয়, কেউ জানে না। তবু একদিন আমরা সেই বীজ থেকে উঠে আসা গাছটাকেও দেখে ফেলবো... আর ভাববো, এ সিনেমা যখন তৈরি হয়, তখন এক স্রষ্টার ফুসফুসের ছ-খানা ফুটো দিয়ে স্রেফ যুদ্ধের সিম্ফনি আর দেশ রাগের সুর বেজে উঠতো।
________
৫০ বছরে ঋত্বিক ঘটকের যুক্তি তক্কো আর গপ্পো (১৯৭৪) / সহায়ক পাঠ ও তথ্যসূত্র
১। লেখায় ব্যবহৃত ঋত্বিক ঘটকের উক্তি, মন্তব্য ও সাক্ষাৎকারের অংশের সূত্র - ‘চলচ্চিত্র, মানুষ এবং আরো কিছু’ – ঋত্বিককুমার ঘটক (প্রথম প্রকাশ, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ১৯৭১)
২। ‘ঋত্বিক কুমার ঘটক, তাঁর যুক্তি তক্কো আর গপ্পো’ - সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়
৩। ‘রঙ্গমঞ্চ’, বিচিত্র প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
৪। ‘মন্দির’, বিচিত্র প্রবন্ধ, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর